ইনামুল হক চৌধুরী: উত্তাল সময়ের এক সাহসী নায়ক
মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা
ইনামুল হক চৌধুরী বীরপ্রতীক ছিলেন একজন অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন যারা লালন করেছিলেন তাদেরই একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ইনামুল হক চৌধুরী। আজ এই মহান বীরের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ইনামুল হক চৌধুরী ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ছিলেন টগবগে যুবক। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন প্রতিরোধযুদ্ধে। পরে মা-বাবার অনুমতি নিয়ে ভারতে গিয়ে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। পাঁচ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন তিনি। পরে তাঁকে এই সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আবেগী যোদ্ধা নন, আদর্শিক চেতনাগত কর্তব্য পালনে জীবনবাজি রেখে পরিচালনা করেছিলেন একের পর এক সাহসি অভিযান। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামে ৫ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রদর্শন করেন অসামান্য নৈপুণ্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শুধু থেমে থাকেননি পঁচাত্তর পরবর্তী চরম অমানিশাকালে জয়বাংলা আর বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে পালন করেছেন অনন্য ভূমিকা।
আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে ইনামুল হক চৌধুরী ১৯৭৯ সালে ও ১৯৮৬ সালে সিলেট-২ আসন (বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পালন করেন অসামান্য ভূমিকা। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের শীর্ষ স্থানীয় ছাত্রনেতা হিসেবে সিলেট অঞ্চলে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। ১৯৬৮-৬৯ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন কলেজের ভিপি হিসেবে ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সফল সংগঠক। রাজনৈতিক সহকর্মীদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা আক্রমণের জন্য গড়ে তুলেন এক সাহসী বাহিনী। যারা সকলেই সম্মুখ সমরে রেখেছেন অসামান্য অবদান। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেন তিনি। বালাট সাব সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে তাঁর দূরদর্শী অনেক সিদ্ধান্ত পাক বাহিনীর জন্য আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুনামগঞ্জ শহরসহ বেরীগাঁও যুদ্ধ, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর যুদ্ধে তাঁর সাহসী নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীকে বিতাড়িত করে। অনেক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম হাওরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন প্রজ্ঞাবান এই জনযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর সিলেট পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। নির্বাচনে সফল হতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশপুর্নগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী এই সংগ্রামী জননেতা জীবনের শেষের দিকে রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম গঠন করে সিলেটে সক্রিয় তৎপরতা চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন সংগ্রামী এই গণযোদ্ধা। এমন বীরত্ব গাঁথার সাহসী যোদ্ধাকে নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেননা। ২০০৮ সালে এক সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাঁর অভিমান আর কষ্টের কথা অনুভব করেছিলাম। আদর্শিক স্বপ্নবাজ মানুষগুলো রাজনীতি থেকে কেন দূরে চলে গেলেন। দল ও দেশকে দেওয়ার মতো অনেক যোগ্যতা থাকা সত্বেও অনেকটা অবহেলিত ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এমন জননায়কদের নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত এসব বীর নায়কদের অবদানের কথা। বালাগঞ্জের সুলতানপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ইনামুল হক চৌধুরী দেশের উত্তাল সময়ের এক প্রভাবক চরিত্র। দেশমাতৃকার টানে জীবনবাজি রেখে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তারা পরবর্তী সময়ে কি যথাযথ মূল্যায়ন পেয়েছেন। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই এর বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন । ইনামুল হক চৌধুরীর এক অসামান্য বীরত্বের বর্ণনা রয়েছে প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত “একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা” প্রথম খন্ড বইয়ে। এই বইয়ের একটি অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম —
” রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান নিলেন ইনামুল হক চৌধুরীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা শুরু করলেন অতর্কিত আক্রমণ। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। তাদের গুলিতে ইনামুল হক চৌধুরীর কয়েকজন সহযোদ্ধা মারা যান। কিন্তু যুদ্ধে কোনো ছেদ পড়ে না। চলে আপ্রাণ লড়াই। পাকিস্তানি সেনারা কিছু এগোয় তো মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে যান। মুক্তিযোদ্ধারা একটু এগোলে পাকিস্তানি সেনারা পিছিয়ে যায়। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে প্রকম্পিত পুরো এলাকা। একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনকে পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আটকে পড়া দলে ছিলেন ইনামুল হক চৌধুরী। মুক্তিযোদ্ধাদের আটকাতে পেরে পাকিস্তানি সেনারা উল্লাস করতে থাকে। কেউ কেউ জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘উসকো গুলি মাত করো, উসকো জিন্দা পাকড়াও’ ইত্যাদি। তারপর ওরা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চারদিক থেকে আওয়াজ তোলে। ইনামুল হক চৌধুরী বিচলিত হলেন না। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি সেনাদের ধোঁকা দেওয়ার। চোখের ইশারায় সহযোদ্ধাদের সংকেত দিলেন হাত ওপরে তুলতে। তিনি ও দলের অন্য সদস্যরা হাত ওপরের দিকে তুললেন। এক ফাঁকে তিনি আবার চোখের ইশারায় সহযোদ্ধাদের পাশের নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা একসঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেন। ডুবসাঁতার দিয়ে প্রশস্ত সুরমা নদী পার হতে থাকেন। মাঝেমধ্যে মাথা উঁচিয়ে শ্বাস নেন। হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা নদীর বুকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। নদীর ওই পাড়ে পৌঁছে মিনিট পাঁচেক জিরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিরাপদ দূরত্বে যান মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে সহযোদ্ধা নায়েক সুরত আলী ইনামুল হককে ইশারায় জানান, তাঁর পায়ে রক্ত। এতক্ষণ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়েছেন ইনামুল হক চৌধুরী। পায়ে গুলি লেগেছে টেরই পাননি। পরনের লুঙ্গি ছিঁড়ে পায়ে বেঁধে দেন সহযোদ্ধারা। সুনামগঞ্জ জেলার ষোলঘর এলাকায় ঘটে এ ঘটনা।”
সময়ের সাহসি সন্তান, সংগ্রামী জননেতা ইনামুল হক চৌধুরী বীরপ্রতীকের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা: সাংবাদিক ও লেখক।