পরিবানু

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।  –সম্পাদক, সত্যবাণী।

 হামিদ মোহাম্মদ

॥৩॥

তিন বছরের শিশুপুত্র উজ্জলকে নিয়ে আমি রেণু যে চারচালা ঘরে ওঠি, তা তৈরী করেছেন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসার পর মা’র চাপে মেজোভাই। মেজোভাই বাবলু রহমান, তাও বেকার। শহরে ঠাঁই বলতে এ ঘরখানি একমাত্র মাথাগোঁজার। মা, তিনভাই ও এক বোন, বলতে আমি নিজে ছিলাম সদস্য। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় যে একজন কমেছিলাম, আবার পুরণ হল, অর্থাৎ আমি রেণু ফিরে আসায়। মূলত পিতা থেকেও নেই, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিয়ে করে সংসার যে তচনচ করেছিলেন, তা ভেতরে তিনটি রুম শোয়ার, আরেকটি রুম বসার, পাকঘর এবং পেছনে এক চিলতে খালি জায়গা সামনে বড়সড় একটি খোলা জায়গা–বলতে গেলে আমাদের নিজস্ব দুনিয়া। আমার মা আফিয়া বেগম একা সংসার সামলান। তার দুই পুত্র, এখন যোগ হলাম আমি রেণু তিন বছর বয়েসী পুত্র ‘উজ্জ্বল’–আরেকজন বাড়তি মানুষ, শিশু হউক, তবু তো সংখ্যা বৃদ্ধি।

আমার মা আফিয়া বেগমের আট সন্তান। চারপুত্র, চারকন্যা। একপুত্র লন্ডনে লাপাত্তা। বাকী তিন পুত্রের এক পুত্র ইতালি এবং দুইপুত্র দেশে, বলতে গেলে এরা  দুজনই মায়ের কোলেই–পড়ালেখার প্রতি উদাসীন। ছোটটি কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা বলার অভ্যাস। ইতালি প্রবাসী ও দেশে মা’র মেজোপুত্রটি অর্থা আমার ভাই বাবলু রহমানই একমাত্র কাজের। বাজার-আট, ঘরগেরস্তি, পেছোনো, না এগোনো গেল, তাই নিয়েই একটু ভাবে, যদিও বেকার, আত্মীয়-স্বজন অন্যদের সাথে সম্পর্ক, যোগাযোগ স্থাপনসহ সংসারকে টেনে চলছে। ইতালি থেকে যা-পারে নিজের পেটকে বুজ দিয়ে টাকা পাঠায় অন্য ভাইটি–এই অবস্থায় টানাটানির সংসার আফিয়া বেগমের অর্থাৎ আমার মার।

আমি রেণু চিরদিনের জন্য ফিরে এসেছি মা’র বাড়ি।  বাপ থাকলেও নেই, গ্রামের বাড়িতে থাকেন তিনি, আবার থাকেনও না। দেশে দেশে ঘুরেন, কোথায় থাকেন, কোথায় খান, কেউ ভাল করে জানে না। শহুরে হয়ে যাওয়া সতীনদের জ্বালায় বাড়িছাড়া আমাদের মা আফিয়া বেগম সংসারের তত্ত্ব-তালাবি করেন, দেখাশোনার দায়িত্ববান, সব কিছুই বর্তায় মা আফিয়া বেগমের ওপর, এ পক্ষের সমুদয় ভার তার ঘাড়ে।

আমি রেণু ফিরে আসা রটে যায় পাড়ামহল্লায়, গ্রামে। মানুষজন মুখেমুখে নানা কথা রটায়। আফিয়া বেগম  আমার মাও চটজলদি কাহিনি একটা বানিয়ে নেন। সে কাহিনি লোকজন মেনে নেয়। আমারবর দশ লাখ টাকা যৌতুক দাবী করেছিল, দিতে না-পারায় সংসার থেকে তাড়িয়ে দেয় পাগল ঠাউরিয়ে। এটা গ্রাম্য পলিটিক্স এখন। সত্য মিথ্যা যাচাই লাগে না, মুখে তুললেই পগার পার। মানুষও লুফে নেয় এসব কাহিনি-টাহিনি।

এরই মধ্যে মা আফিয়া বেগম অল্পদিনেই বদ্ধ পাগল, যার-তার দিকে তেড়ে যান। কী জন্য পাগল–ডাক্তার-কবিরাজ ফেল। এমনি একদিন মা তার শাড়িতে আগুন দিয়েছেন। আগুনে পুড়ে খাক। নাইলনের শাড়ি পুড়ে শরীরে লেপ্টে যায়। দগদগে, থ্যাক থ্যাকে অবস্থা।আমি ছিলাম বাইরে,ঘরে এসেই দেখি সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে ছুটছেন।  হাসপাতালের বেডে পলিথিনের বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে সাতদিনের মাথায় পরপারে গমণ। পাড়ায় এ নিয়ে হুলস্থুল। কানাগোসা বাড়তেই থাকে। কাহিনি ডালপালা মেলে।

এসব ডালপালা মেলা কাহিনির এক প্রান্তে আমি রেণু। এই প্রান্তিক আমি রেণুকে অল্পদিনের মধ্যে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ভাই বাবলু। বাবলু মানে বাবলু রহমান। তার যুক্তি ‘রেণু নিজের আক্কেলের কারণে স্বামীখেদা হয়েছে। ঘাড়ে পড়েছে তাদের। টানাটানির সংসারে সে এখন আপদ বা বোজা। এ বোজা টানার জন্য তারা প্রস্তুত নয়। তার কারণেই মা’র পাগল হওয়া, আগুনে পোড়া, মৃত্যু।’

মা আফিয়া বেগম তারছেলের এমন আচরণ আগে থেকেই অনুমান করছিলেন। প্রথম থেকেই হিমসিম খান। সব ঘটনার পেছনে তিনি নিজের জড়িয়ে থাকাও অন্যতম কারণ, সে বিষয়টিও চাউর আছে অনেকটা গোপনে গোপনে। এই যাতনার শেষ কাহিনি মা আফিয়া বেগম পাগল হওয়া, তারপর শাড়িতে আগুন দিয়ে মরা। সবাই জানে আগুনে-পুড়ে মরা হয়েছে। আসলে, আত্মহত্যা। এটা জেনেই বা বুঝতে পেরেই, বিরক্ত হয়ে বাবলু রহমান একদিন আমি রেণুকে তাড়িয়ে দেয়। কোথায় যাবো, সে বিষয়টিও মাথায় ঠাই দেয়নি। যেন আরেকটা পাগলের আর্বিভাব।

আমাদের মা আফিয়া বেগম বিপত্মীক নন, সপত্মীক ছিলেন। সেই পতি আমাদের বাবা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘরনী নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দিনগুজরান করেন। মাঝে মাঝে খেতের ধানফান, ফয়-ফসল এনে দেন। এ হল আফিয়া বেগমের পক্ষের অর্থাৎ আমাদের বাড়তি জমিজিরাতের ফসল প্রাপ্তি।

আমি রেণু’র বিয়ে হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট শহর থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে শাকিলপুর, সম্পর্কে খালাতো ভাই। নাম আফজাল মিয়া। তিনি আরব দেশে এক আতরের দোকানের পার্টনার। বাড়িতে আরও তিনভাই। পূবমুখী গ্রামের পূব পাশেই খামারবাড়ির মালিক তারা। পাশ দিয়ে রেল লাইন গেছে সিলেট থেকে ঢাকা। রেল লাইনের পাশে রয়েছে দু’লেন বিশিষ্ট সিলেট-ফেঞ্চগঞ্জ সড়ক। পূব দিকে খোলামেলা পূবের বন্দ, ধানি জমি। কিন্তু গ্রামের পূব পাশে রেললাইন লাগোয়া বিশাল না হলেও বড় পাঁচটি পুকুরের খামার বাড়িটির প্রশংসা লোকজন করতে শোনা যায়, দেখামাত্রসেই ধান-মাছভরা বাড়ির বউ ছিলাম আমি রেণু। ছ’সাত বছর কাটিয়ে এখন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হয়েছি এই বাড়ি থেকে। এখন আমি রেণু এই বাড়ির কেউ নয়, ভিন্ন এক মানুষ।

আমি দেখতে কালোও নয়, সাদা ফর্সাও নয়, লোকে শ্যামলা বলে। কিন্তু  লোকে বলে ‘পুতুলের মত চেহারা, চোখ দু’টো মিশমিশে কালো ও বড়। লম্বা গড়ন। শাড়ি পরলে মনে হয় কী এক মূর্তি, হয়ত বা কোন দেবী। পেছন থেকে দেখলে আসলেই দৃশ্যবতী এক দেবী-।’ এরকম অনেক প্রশংসা শুনেছি অনেকের কাছ থেকে। আফজালও এসব বলে পাগল করে তুলতো।

তিন বছরের পুত্র সন্তানকে বগলদাবা করে কেন যে  আমি রেণু বাড়িছাড়া হলাম, সে কাহিনি আমার নিজের চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে। নাগধোনার ধোঁয়াঘেরা সন্ধেটা চোখ কচলিয়ে কচলিয়ে দেখি। আর তখনই এক অচেনা ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই।

আর সে ধ্যান থেকেই চোখ তুলে দেখি দুধসাদা, আটসাট বসনে আবৃত এক পাল তরুণী, আমার স্বামী আফজালকে ঘিরে নৃত্য করছে।

তিনমাস আগে থাইল্যান্ডের পুকেট গিয়েছিলাম আমরা। মানে আমি ও স্বামী আফজাল মিয়াআগেই বলেছি, আফজাল মিয়া সৌদি আরবে একটি আতরের দোকানের পার্টনার। বছরে একবার দু’মাসের জন্য ছুটি পায়। তখন দেশ ঘুরে যায়। বিয়ের পর ছ’বছরে ছ’বার এসেছে আফজাল মিয়া। এবার এসে থাইল্যান্ড বেড়াতে নিয়ে যায় আমাকে। এই প্রথম আমার বিদেশ ভ্রমণ।

কী যে তাজ্জব? বেটি মানুষরা নেংটা নাচ দেয়। আমি প্রথম মনে করেছিলাম নেংটা। পরে বুঝলাম–না, নেঙটা নয়, পাতলা কাপড় শরমের জায়গায় পুচমারা। বুকে রঙবেরঙের নেট-কাপড়ের টুকরার ব্রা।

আমি রেণু তাজ্জব হই ভেবে ঘুমহারা হই  মনে করি, আমার স্বামী এই আধা নেংটাদের লেবাসের ঘোরের মধ্যে বোধ-হয়ে বিদেশে হয়ত থাকে, বা আছে। না হলে বছরটা কীভাবে কাটে আমাকে ছাড়া, অর্থাৎ বউ বিহীন। এই ধুন ছাড়ানোর জন্য আমি রেণু হাওলা নিই এক পীরের। পীরের বাড়ি সিলেট শহরের টিলাগড়। তিনি, কোন লোক চাইলে তার কাঙ্খিত তরুণীকে পাইয়ে দেন। আবার কাউকে কোন আছর থেকে বাঁচাতেও কাজ করেন। কেউ যাতে কোন ডাকিনী বা বেজুত মেয়ের পাল্লায় না-পড়ে সে তদবির করেন। দেন নাগধোনা ও চন্দন কাঠের পোড়া ধোঁয়া সেবন আর দম।

আমার বিশ্বাস আমার স্বামী আফজাল মিয়া বিদেশে সময় কাটায় ঐসব নেংটা নারীদের ধুন্ধে। এসব নারী বা এমন কেউ কেড়ে নেয়ার ফন্দি যদি আটে, তা থেকে বাঁচার ফন্দি বা ধান্ধা করা জরুরী। সেই থেকে টিলাগড়ের পীরের হাওলা নেয়া। সন্ধে হলে মাগরিবের আজানের লগে লগে ধুন করা, নাগধোনা পোড়ানো ধূয়া ও দম নেয়া।

বিবাদ তখনই বাঁধে। বিবাদের শুরু আমার পরিবারে, তথা শশুড় বাড়ি। কিন্তু শশুড় বাড়ি থেকে দ্বন্ধ শুরু হলেও এর গোড়া আরো পেছনে। মাতা আফিয়া বেগম যার গোড়া পত্তন করেন। তিনিই নিজ জীবনে তাবিজ-তুমার, তদবির, মোল্লা-মুনসী ছাড়া বুঝেন না। এর জের পড়ে আমার নিজের জীবনে, ঘটনার পর ঘটনায় জড়াই। বালিশের নীচে তাবিজ, পানিতে ছোবানো তাবিজ, ঘরের দরজার চারকোণায় তাবিজ, গাছের ডালে তাবিজ–কত কী!

অন্যসব কিছু গোপনে ঘটলেও, মাগরিবের নামাজের আজান পড়ে, তখনই হিন্দুদের মত উলুধ্বনি দিয়ে নাগধোনা-পোড়ানো, দম নেয়া কাণ্ড মেনে নেয়নি শশুড়বাড়ির মানুষজন। এই বিবাদ থেকেই ছিটকে পড়া। এখন তিন বছরের পুত্রসন্তান নিয়ে বাপেরবাড়ি। বাপের বাড়ি নয়, বলতে গেলে মায়ের বাড়ি। (চলবে)

You might also like