পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥পাঁচ ॥
স্বামীখেদা আমি রেণু এখন ভাইয়ে খেদা, সাড়ে তিন বছরের পুত্র সন্তান নিয়ে উঠি কলোনীর দু’রুমের একটি একচালায়। একটানা লম্বা একটি ঘর। ছোট দশ পরিবারের সংস্থান হওয়া মুখোমুখি দু’টি এমন ধরণের ঘর, যেটিকে কলোনী বলেই শহরের মানুষ বলে থাকে। পেছনের দিনগুলোতে তাকালে আমি দেখতে পাই না কষ্টের কোন চিহ্ন। ছিল না কোন দূর্ভাবনা কিংবা কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টা অথবা কোনদিন এমন ধসে পড়ার চিন্তাও মাথায় আসেনি। সেই দিন পানসে, এখন উঠে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে ভর দিয়ে, জীবনটা যতই অন্ধকার গলির দিকে ধাবিত বা যাওয়া হউক, পথ নিজেকেই বের করতে হবে। পাশের ঘরের আরেক স্বামীহারা মহিলা কাজ করেন একটি টেইলারিংয়ে, আমি রেণু স্থির করি নিজেসেলাইয়ের কাজ শিখে আয়-রোজগারের পথ তৈরী করবো, এ ছাড়া উপায় নেই। টেইলারিংয়ে কাজ-করা মহিলার নাম জাহানারা বেগম। কলোনীর সবাই তাকে জানুবুবু ডাকে। আমি এই মহিলাকে শুধু বুবু বলেই সম্বোধন করি, জানুবুবুও তৃপ্তিবোধ করেন এমন সম্বোধনে। আপন আপন লাগে ডাকটি। তিনি যে টেইলারিংয়ে কাজ করেন, সেখানে একদিন নিয়ে গেলেন আমাকে। দেশে গার্মেন্টস ব্যবসা রমরমা। টেইলারিংয়ে কাজ শিখলে অনায়াসে কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একটি ভাল কাজ জুটতে পারে, এটিও একটি স্বপ্ন এখন বর্তমান তরুণ-তরুণীদের। আমার ভাবনা এতটুকু না-হলেও, এই পেশায় সামান্য আয়-রোজগার হবে ভেবে এই মহিলার পিছু লাগা। মহিলারও সায় ছিল। ভাবনা অনুযায়ী এই মহিলার কাজের জায়গাটিতে আমিও কাজ পাই।
দু’মাস কাজ শেখার পর আমার মাথায় আসে ঘরে বসে কাজ করার। ছেলে উজ্জলকে একটি স্কুলে ভর্তি করেছি টেইলারিংয়ে কাজে যোগদানের সময়। এর আগে ঘরেই নিজে পড়িয়েছি। বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা, গণনাসহ কিছু কিছু ছড়ার বইপড়া, ছবি আঁকা শিখিয়েছি। সকালে স্কুলে দিয়ে আমি কাজে যাই, বিকেলে ফিরতিপথে নিয়ে আসি ছেলেকে। ছেলের নাম স্কুলে লিখিয়েছি উজ্জ্বল রহমান। বাড়ির সবাই ডাকতো আবিদুর রহমান। কিন্তু আমি আমার মত ভাবি। তার পিতার বাড়ির মানুষের পছন্দের নাম হউক আর যে কোন স্মৃতি হউক মুছে দিতে চাই। আমি ভুলতে চাই ফেলে আসা গণগণে জ্বলন্ত স্মৃতি। তাই, আমার পছন্দের ‘উজ্জ্বল রহমান’ নামটি স্কুলের খাতায় লিখিয়ে নিই। মনে চোট লেগে আছে, যে লোকটি তার ঔরসজাত সন্তানকে খোঁজই করে না, তার আবার স্মৃতি জিয়ে রাখার কোন মানে হয় না।
সেলাই কাজ মোটামুটি শেখার পর সিঙ্গার কোম্পানির শোরুম থেকে কিস্তিতে শোধ করার চুক্তিতে একটি সেলাই মেশিন, একটি ইস্ত্রি ও একটি লগিং করার মেশিন নিয়ে আসি আমি। সনাক্তকারি হিসেবে জানুবুবু অর্থাৎ জাহানারা। আমার বিশ্বাস আপাতত ব্লাউজ, পেটিকোটসহ ছোট ছোট কাজ বিভিন্ন হোলসেইল বা রিটেইল দোকান থেকে নিয়ে আসবো। এই ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে এতদিনে। যে টেইলারিংয়ে কাজ করি আমি, তারাও অর্ডার নিয়ে আসে এসব দোকান থেকে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহসটা তো নিজেকেই করতে হবে, এই চিন্তা নিয়ে ঘরে বসে স্বাধীনভাবে কাজ করার ব্যবস্থা মাথায় আসে।(চলবে)