কত গাঁথা- কত সুর: পর্ব-১
সৈয়দ জগলুল পাশা
(ভ্রমনকাহিনীর ধারাবাহিক পর্ব)
পর্ব-১
প্রায় ২৮ ঘন্টা ট্রেন যোগে সফর করে মুম্বাই পৌছলাম। দিল্লী থেকেই পূর্ব হতে ফোনে ঠিক করা ছিল আবাসস্থল -চিরাবাজার চ্ন্দনওয়াদি কর্নার। ঘন বসতি এলাকায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার জন্য দশতলা ভবনের একটি ছোট ফ্লাট। বিকেলে ততকালীন বোম্বে রেল স্টেশনে পৌঁছে বেশি বেগ পেতে হয়নি আবাসস্থল খুঁজে পেতে। কপালে চন্দন ফোটা দিয়ে স্বাগত জানালেন মধ্য বয়সী গৃহকত্তৃ। অদূরে অপলক নয়নে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতী নমস্কার প্রদর্শন করলে বাসার মালিক বললেন – হামারা লেড়কি। তারপর ক্ক্ষ দেখিয়ে দিলেন। তিন বা চার রুমের ফ্ল্যাট। এর মাঝে একরুম পেয়িং গেস্টদের জন্য। পারিবারিক পরিবেশে থাকা। আমার রুম ভাড়া ৩০ টাকা। খাবার খেলে খরচ আলাদা। আমি যখন পর্যটক তখন আর এসবের দরকার হয়নি।
একটু পর এক কাপ চা নিয়ে এলো বাসার একমাত্র কন্যা। আলাপের প্রচেষ্টা নিলাম।আমার হিন্দি জ্ঞান বেশ ভালো বলতে হয়। কারণ বাংলার সাথে ‘হায়’ যথাযথ জায়গায় লাগিয়ে দিতে পারলেই চলে। বাকিটা ভংগিমা দিয়ে বোঝানো যায়। তরুণী নিরুত্তর – একঝলক সু্ন্দর হাসি দিয়ে বিদায় নিলেন।
কয়েক দিন থাকা হলো মুম্বাইয়ে। এত বড় জায়গা সব দেখতে হলে অনেকদিন লাগে। ইতোমধ্যে কৌশল জানা হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন সংস্থার প্রতিদিনের টুর এ খুব ভালো আয়োজন। বিভিন্ন দেশের লোক থাকে, গাইড থাকে এবং কম সময়ে বেশি দেখা হয়। খৃষ্ট পূর্ব কালের কানেরী কেভে পাহাড় কেটে করা মনোলেত্তিক বুদ্ধ, ফিল্ম সিটি, একুরিয়াম, জুহু বীচ, কমলা নেহরু পার্ক, মহাত্মা গান্ধী যেখানে থাকতেন তা দেখা হয়ে গেছে। মুম্বাইয়ের সবচেয়ে সু্ন্দর জায়গা মেরিন ড্রাইভ। অর্ধ চন্দ্রাকার ড্রাইভ আরব সাগরের কোল ঘেষে। বিকেলে সুন্দর সমাগম হয় বিচে। আমাদের চানাচুর বা বাদাম ভাজার মত ওখানকার জনপ্রিয় ভেলপুরি ও পানিপুরি। পানিপুরি হলো আমাদের ফুচকা। সব খাওয়া হল। প্রথম একক প্রচেষ্টায় সামান্য পানীয়ের স্বাধ নিতে গিয়ে মাথা ও পায়ের দোল সামলানোর সফলতা নিয়ে রাতেই ফিরতে হতো। তরুণীর তখন দেখা মিলতো না। একদিন আগে ফিরে এলে দেখলাম আমার কক্ষেই তরুণীর অংকন পরিচর্যা। পালানোর পর দেখা হয়নি।
তাজ হোটেলের সামনের ইন্ডিয়া গেট থেকে বোটে ১১ কিলোমিটার সাগরের ভ্রমণে পাওয়া গেল পর্তুগিজ এলিফেন্টা কেভ। দ্বীপ, পাহাড়ের মত শতাধিক সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সত্যেনদার মসলার যুদ্ধ বইয়ের কথা মনে হয়। ভারতের বানিজ্য সন্ধানে কত দেশ থেকে কত লোক এসেছিলো।
জুহু বীচ দেখে মনে হয়েছিল আমাদের কক্সবাজার অনেক সুন্দর ও বিস্তৃত। আমরাতো মেরিন ড্রাইভ পতেংগায় করতে পারি। আমাদের পাহাড়পুর কতটা ঐতিহ্যময়।আমাদের দ্বীপ গুলো আরো আকর্ষণীয় হবে একদিন।
ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ২১ দিনের পাশ নিয়ে মুম্বাইয়ে এসেছি। দু-তিন কেটে গেছে বৈকি। হঠাৎ বাংলাদেশের ফলাও সংবাদ – রা্ষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ব্ন্ধ। গোয়া, হায়দরাবাদ সহ অন্য অনেক জায়গায় যাওয়া হলো না। দেশের কথা ভেবে কলকাতায় বিমানযোগে চলে আসার গোছগাছ দ্রুত করে ফেলি। বাসায় ফিরে গৃহ কর্তৃকে জানাই আজ অপরাহ্নে যাত্রা। বিল পরিশোধ হলেও উনার পিড়াপীড়িতে এবার আমার কমপ্লিমেন্টারি লান্চ হল। অতঃপর বিদায় বেলা সুনয়না তরুণী সচকিত হয়ে এলেন সামনে। আমার আশ্চর্য হিন্দি থেকে উচ্চারিত হলো -এতদিন দেখা হয়নি কেন? তরুনী ভীরু পায়ে এগিয়ে এসে তাঁর অসমাপ্ত নিসর্গের একটা ছবি হাতে দিলেন। কোন কথা হলো না। গৃহকর্তৃ হিন্দিতে জানালেন – মেয়ে কথা বলতে পারে না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে পেছনে না ফিরে বিমানবন্দরের জন্য অটো ধরলাম। (চলবে)
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)