কত গাঁথা-কত সুর: পর্ব-৩
সৈয়দ জগলুল পাশা
পর্ব-৩: অমলিন সান্নিধ্যে
১৯৮১ সাল জুন। মোম্বাই থেকে কলকাতা ফিরে সস্তি এলো। দেশের কাছে চলে এসেছি।আমার প্রথম ভারত সফরের অনেক এখনো বাকি।ভারতীয় তথা পশ্চিম বংগ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ” কালান্তর” পত্রিকা মেসে থাকেন রনেশ দাশ গুপ্ত। রনেশদা ১৯১২ সালে জন্ম গ্রহন করেন। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অনুশীলন দল ও কমিউনিষ্ট আন্দলনে জড়িয়ে পড়ায় আর পড়ালেখা হয়নি। মুনসিগন্জের সন্তান রাজনীতি, সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন জীবন জুড়ে। ১৯৫৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কমিশনার নির্বাচিত হন। সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সাথে সংগঠিত করেন – প্রগতি লেখক সংঘ। সতেন সেন এর সাথে মিলে গড়ে তোলেন – উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। অনেক বই লিখেছেন। তাঁর ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা ‘বই আমাকে আকৃষ্ট করে। তিনি সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন। তাঁর তিরোধান হয় ১৯৯৭ সালে। তাঁকে ১৯৯৮ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। আজীবন অকৃতদার থেকে গেছেন।
১৯৮১ সালে কলকাতায় ভ্রমণকালীন আমি প্রায় প্রতিদিন যেতাম উনার কাছে। মেসবাসী তিন বয়োবৃদ্ধ বিপ্লবী দাওয়াত দিলেন মেসে একদিন লান্চের। ৭২ উর্ধ্ব একসময়ের বিপ্লবীদের জীবনযাত্রা জানা হবে বটে। ঐদিনই মাজারী চালের ভাত হলো। সবজি, ডাল ও কই মাছ যুক্ত হলো আমাদের দুজনের জন্য। কলকাতার আরেক তরুণ। একটা ডেজার্ট ছিল -ছোট আম। কত অসাধারন সাধারন জীবন উনাদের। সেচ্ছায় মানুষের মুক্তির সংগ্রামে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আমাদের ভালো লাগলো।
পচাত্তরের পর রনেশ দা চলে যান কলকাতা। সেখানে তখন অন্যত্র থাকতেন উনার দিদি। প্রতি শনিবার বা রবিবার যেতেন দিদির ওখানে। সীমিত পরিধেয় ধুয়ে শুকানো হত-অতঃপর তা শুকালে ফিরে আসতেন পার্টি মেসে।
আমার তখনও শান্তি নিকেতন দেখা হয়নি। মাত্র চার /পাচ মাস আগে রনেশদার সাথী সাহিত্যিক সত্যেন সেন গত হয়েছেন। আক্ষেপ হলো -আমি উনাকে এ জীবনে দেখতে পেলাম না। আমি শান্তি নিকেতন যাবো বলে দাদা বললেন – তথায় বসবাসরত সত্যেন দা র দিদিকে দেখে এসো। তিনি চিঠি লিখে দিলেন। দিদি থাকতেন তাঁর অসুস্থ পুত্রকে নিয়ে। আমাকে অনেক আদর অাপ্পায়ন করেছিলেন। তাঁর হাতের স্বাধু পায়েস এর মত পায়েস আর কখনো খাওয়া হয়নি।
রনেশ’দা আমাকে নিয়ে পুরো একদিন বেড়াতে গেলেন কলকাতার কয়েক জায়গায় । আমি টেক্সী নিতে চাইতুম- কিন্তু তা হয়নি। অসাধারণ তরুনকে নিয়ে ট্রাম, বাস ও হাটা হল আমাদের বাহন। গিয়েছি কমরেড ইলা মিত্রের বাসায়। ঝিনাইদহে জন্ম নেয়া ইলাদি বেথুন কলেজ কলকাতা থেকে ডিগ্রি ও পরে এম এ অর্জন করেন। বৃটিশ ভারতে চাপাই নবাবগঞ্জের জমিদার নন্দন রমেন মিত্র কে বিয়ে করে নাচোল আসেন। গড়ে তোলেন শাওতাল কৃষক বিদ্রোহ – তাদের রানীমা হয়ে উঠেন তিনি। ইলাদি এতলেটও ছিলেন। ১৯৪০ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য স্থগিত জাপান অলিম্পিক এর জন্য নির্বাচিত ছিলেন। ১৯৫০ এর বিদ্রোহের জন্য তাঁকে সীমাহীন টর্চার ও যাবত জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। পরে ১৯৫৪ সালে পেরোলে মুক্তি পেলে কলকাতা চলে আসেন। ৪ বার পশ্চিম বংগ রাজ সভায় সদস্য হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। ইলাদি’কে গিয়ে বাসায় পেলাম নিজ হাতে কাপড় ধোয়ায়, রমেন দা স্বাগত জানিয়ে বসে গল্প করছেন। চা এর সাথে সাধারণ বিস্কুট অসাধারণ হয়ে উঠলো। রমেন দা ও ছেলে রনেন মিত্র সাংবাদিক। বিপ্লবীদের সাদামাটা জীবন দেখে -এক অন্য রকম ভালো লাগা হলো ।
রনেশদা নিয়ে গেলেন “পদাতিক কবি” সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর বাসায়। কবি খুব আপন করে নিলেন। আমার মনে হতে থাকলো তাঁর কবিতার কালোত্তীর্ন চরণ-” ফুল ফোটুক না ফোটুক আজ বষন্ত”। কবির বাড়ী লাল রংগের দালান। অভিজাত বা বনেদি এলাকা। সামনে সুপরিসর জায়গা। অনেক কথা জানা হল। কবি তখনও বাংলাদেশে আসেননি। জানলেন ওনার বইয়ের জনপ্রিয়তার কথা। বলেছিলেন কোন এক প্রকাশককে যথাযথ রয়েলটির তাগাদা দিতে। পরে দেশে এসে পারিনি। একাজটা খুব কঠিন। চা-নাস্তা খাওয়া হলো অটোগ্রাফ ও নিলাম। ফেরার পথে হেটে হেটেই রনেশদা দেখালেন শরৎচন্দ্রের বাড়ী, সন্দেশ পত্রিকার অফিস।
ট্রাম – বাস আর আমাদের ছাড়েনা। আমার জীবনের প্রথম ও এখন পর্যন্ত শেষ ট্রাম চড়া। আমরা এলাম কলেজ স্ট্রিট এর বই পাড়ায় – নাম ভুলে গেছি প্রগতিশীলদের বইয়ের বড় লাইব্রেরিতে। দূয়েক বই কেনা হল। অদূরে কফি হাউছ। জোর করে কফি খাওয়ানো গেল। এদিন বিদায় নিতে হল। বিদায় বেলায় হাতে হাত রেখে রনেশদা বলেছিলেন- আমাদের সময় শেষ হলেও তোমারা মানুষের মুক্তির পতাকা এগিয়ে নিয়ে যাবে। তা্ঁর কথাটি আজও আমার কানে অনুরণনিত হয়। (চলবে)
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)