অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল বামেরা
দিলীপ মজুমদার
সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে কেরল আর পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাস তৈরি করল সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম দল । কেরলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পাল্টে যেত । এবার তার ব্যতিক্রম । বিজয়নের নেতৃত্বে আবার সেখানে জিতে গেল বাম দল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামদলের ভরাডুবি হল । নির্বাচনে তারা কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকিদের নিয়ে একটা জোট গড়েছিল । অনেক তরুণ প্রার্থী দিয়েছিল । ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তাদের সভায় বিপুল জনসমাগম হয়েছিল । তারা আশা করেছিল এবার তারা ঘুরে দাঁড়াবে । কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল বাম ও কংগ্রেস কোন আসন লাভ করতে পারে নি । তাদের জোটে আব্বাস সিদ্দিকির দল একটি মাত্র আসন লাভ করেছে । সিপিএমের নেতৃত্বে বামেরা শুধু যে আসন লাভ করতে পারে নি, তাই নয়, তাদের ভোটের হারেও ধ্বস নেমেছে বিরাটভাবে । বহু আসনে প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়েছে তাদের ।
এই ফলাফল তারা আশা করে নি । কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে বামেদের এরকম বিপর্যয়ের কারণ আছে । উটপাখির মতো তারা বালিতে মুখ গুঁজে ছিল, বিপর্যয়ের কোন সংকেত দেখতে পায় নি । প্রথম কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট । এমনিতে দল হিসেবে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ম্লান । তার উপর একদা কংগ্রেসের হাতে অত্যাচারিত হয়েছিল বামদলের কর্মী ও সর্মকরা । সে কথা তারা ভুলতে পারে নি । তাই ২০১৯এর লোকসভা ভোটে বামের ভোট রামে গিয়েছিল । শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নয়, এবার বামেরা সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসানোর জন্য আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গেও জোট করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল । সাধারণ মানুষ এই জোটকে স্বাগত জানায় নি ।তৃণমূল, বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জী সিপিএম তথা বাম দলের গাত্রদাহের কারণ ।২০১১ সালে যেভাবে মমতা ব্যানার্জী তাদের উৎখাত করেছিলেন, সেটা ভুলতে পারে নি বামেরা । তাই মমতার প্রতি তাদের ক্রোধটা যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেকবেশি ব্যক্তিগত । সেই ক্রোধে অন্ধ হয়ে তারা বিজেপি ও তৃণমূলকে এক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে প্রচার করেছে । ‘বিজেমূল’ নামে একটা শব্দ আবিষ্কার করে বিজেপি ও তৃণমূল দুজনকেই প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে । কিন্তু তাদের বক্তৃতায় আক্রমণটা প্রধানত তৃণমূলের দিকেই ছিল ।
আসলে এবারকার পরিস্থিতি বুঝতে পারে নি অথবা বুঝতে চায় নি বামেরা । তারা দেখেও দেখে নি যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতা লাগাতার প্রচার চালিয়ে দেশে বিজেপি বিরোধী মুখ হয়ে উঠছেন।অন্যদিকে বিজেপি তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে এ রাজ্যের নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী ও পদাধিকারীরা নিত্য পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় দলকে কাজে লাগিয়েছেন,রাজ্যপাল নিয়মিত টুইট করে যাচ্ছেন, সেই সঙ্গে বাহুবল আর অর্থবল তো আছেই।এটা কী এক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের নিদর্শন ?পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাঁচতে চেয়েছে বিজেপির হাত থেকে।তারা সঙ্গত কারণে মনে করেছে বিজেপিই তাদের প্রধান শত্রু ।তাই তার চুপচাপ ঘাসফুলে ছাপ দিয়েছে।আর এই বাস্তব পরিস্থিতিকে না বুঝতে পারার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বামেরা।
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।