মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বদেশমুক্তির লড়াইয়ে জেগে ওঠো তারুণ্য

ইফতেখারুল হক পপলু


একটা অন্ধকার এবং কঠিন সময় পার করছে প্রিয় বাংলাদেশ প্রিয় স্বদেশ। গোটা পৃথিবীর সাথে বিচ্ছিন্ন রয়েছে মা মাটি মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগসহ ১৪ দলীয় জোটের একচ্ছত্র আধিপত্য, লুটপাট, দুর্নীতি-দুঃশাসন আর মৌলিক মানবাধিকার লংঘন বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে গিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের একটি বিশাল ছাত্র আন্দোলন উত্তাল করে দিয়েছে গোটা দেশ। ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে শাসক শ্রেণীর। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনে অতিষ্ট গোটা দেশের মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ সরকারের পতনের জন্য উদগ্রীব উঠেছে। কিন্তু সবার চাওয়া এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শ ভিন্ন। একটা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক শক্তির আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান আর প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ জামাত-বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য কখনোই এক হতে পারে না। এই রাজনৈতিক বোধটুকু সবার থাকা প্রয়োজন।

আমি এই মুহূর্তে সাধারণ ছাত্রের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করি। সাধারণ ছাত্রের এই তারুণ্য এবং প্রতিবাদী চেতনাকে আওয়ামী দুঃশাসন রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বাহিনী প্রয়োগ করে ব্যাপক দমন পীড়ন আর হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মাধ্যমে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে আমি তার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একই সাথে সাধারণ ছাত্রের এই উত্তাল তারুণ্যের প্রতিবাদী চেতনাকে জামাত-বিএনপি আর উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা দখলের ফায়দা লুটে নিতে ব্যবহার করছে নীতিগতভাবে আমি তারও ঘোর বিরোধী। একই সাথে এই তারুণ্যের উত্তাল সময়কে বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিও যথাযথভাবে ধারন করতে পারে নাই বলেই আমার ধারণা। অবশ্য দুঃশাসনের এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার সময়ে যথাযথ তথ্য প্রাপ্তির ঘাটতির কারণে আমার ব্যক্তিগত ধারণা ভুল‌ও হতে পারে।। আমি আশা করি অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোর ভোর আসবেই। আওয়ামীলীগের দুর্নীতি, দুঃশাসন- লুটপাট ক্ষমতার অপব্যবহার আর এক‌ই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অশুভ শক্তির রাহু গ্রাস থেকে বাংলাদেশ একটি ন্যায়পরায়ন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাবে এটাই আমার আশাবাদ। স্বীকার করতে আপত্তি নেই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সুমহান একাত্তরের গৌরবৌজ্জ্বল ইতিহাস কে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করলেও আদর্শিকভাবে এই অশুভ শক্তিকে মোকাবেলা না করে রাজনৈতিকভাবে তাদের নীতি দর্শনকে বাংলাদেশে আরো সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী সরকারের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ফলে তারা দুর্বল হয়ে যায়নি বরং ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তাদের শক্তি আরও বিস্তৃত করে চলেছে। ‌ একই সাথে আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হলেই তারা সেখানে ঢালাওভাবে জামাত-বিএনপি’র উপস্থিতি খুঁজে। সব মানুষকেই রাজাকার ভাবে। শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই এমন যে সরকার বিরোধী সব শ্রেণীই এখন রাজাকার।। আর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য, আভিজাত্য আর অহমিকা।। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে এটি কত বড় একটি হুমকি একমাত্র শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরাই তা বুঝতে পারবেন।

মনে রাখা দরকার একটি উত্তাল ছাত্র আন্দোলন একদিনেই বিস্ফোরিত হয়ে উঠেনি। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অপমান আর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সীমাহীন নির্যাতন নিপীড়নের ফল এটি। কিন্তু উত্তাল ছাত্র আন্দোলন কে কেন্দ্র করে একটা বিশাল প্রজন্ম কৌশলে জামাত শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেদের রাজাকার পরিচয় দিয়ে বাংলার আকাশ প্রকম্পিত করুক এটা কোনভাবেই চাই না। এমনকি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সব মানুষকে রাজাকার আখ্যায়িত করলেও কেউ স্বৈরাচারের বরাত দিয়ে নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান তুলুক আমি সেটা চাই না। আমার মনে হয় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কেউ সেটা চাইবেন না। আজকে জামাত-শিবির গর্ব করে নিজামী সাঈদীদের পোস্টার ছাপিয়ে আহবান করছে দেখো জাতি একদিন তোমাদের রাজাকার বলে গালি দেয়া হয়েছিল, ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আজ বাংলার লাখো তরুণ প্রজন্ম নিজেকে রাজাকার বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করছে। এটা আমাদের জন্য যে কত বড় একটি অশনি সংকেত সেটা কি কেউ বুঝতে পারছেন । প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই জামাতী কৌশলের ফাঁদে বামপন্থীদের কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কোন সচেতন মানুষের পা দেওয়া রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যার শামিল হবে।
এবার সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন নিয়ে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলি। আমাদের মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের হাজারো সমস্যার ক্ষুদ্র একটি সমস্যা কৌঠা সমস্যা। কোঠা সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই বাংলাদেশের কাঙ্খিত মুক্তি আসবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই। এই যে বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ তরুণ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে বের হচ্ছে তাদের চাকরির সুযোগ কোথায় এই প্রশ্ন তোলা কি খুব জরুরী নয়। সরকারি বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে বেতন বৈষম্য আছে তার সমাধানের প্রশ্ন তোলা ও আজ জরুরী। মেধাবী হলেই যে চাকরির নিশ্চয়তা আছে এটা ভাবলেন কি করে। বাংলাদেশে এখন অধিকাংশ চাকুরি অর্থ আর রাজনৈতিক আধিপত্য প্রয়োগে নিয়োগ হয়ে থাকে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলা জরুরি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী গরিবের বৈষম্য তথা গরিবের জন্য এক শিক্ষা ব্যবস্থা আর বিওবানদের জন্য আর এক শিক্ষা ব্যবস্থা এই বৈষম্য বিলোপের আহ্বান ও আজ জরুরী। তাই শুধুমাত্র কৌঠাকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগসহ ১৪ দলীয় জোটের শাসনের পতন ঘটানোর চেষ্টা করাটাও আমার কাছে শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব যৌক্তিক মনে হয় না। মূলত লড়াইটা হতে হবে বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক জনজীবনের যে চরম সংকট ও অনিশ্চয়তা তার বিরুদ্ধে একটি সমষ্টিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। ‌আওয়ামীলীগের দুঃশাসন আর জামাত-বিএনপিসহ উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের অশুভ প্রক্রিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাম বিকল্প অথবা একটি উদার গণতান্ত্রিক শক্তির আহবানে আজকে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান আরো স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
একই সাথে তরুণ প্রজন্মের ছাত্র সমাজকে প্রশ্ন করা উচিত তোমরা কি জামাত মৌলবাদী মুক্ত একটি বাংলাদেশ চাও কিনা? লুটপাটকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান চাও কিনা ? সাধারণ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তোমরা একাত্ব হতে চাও কিনা ? একটি শোষণহীন সমতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তোমাদের রাজনৈতিক অবস্থান হবে কিনা? আজকের কঠিন পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে বামপন্থীদের জন্য? এমনকি আওয়ামী দুঃশাসনের পতন ঘটানোর জন্য ধর্মান্ধ মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন সব ধরনের প্রচার থেকে তরুণ প্রজন্মকে মুক্ত করার দায়িত্ব বামপন্থীদেরকেই নিতে হবে। বাস্তব অবস্থাকে আড়াল করা নয়,আবার বাস্তব অবস্থাকে অতিরঞ্জিত করা থেকেও বামপন্থীদের বিরত থাকা জরুরি। আজকের জামাত-শিবির ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের চলমান হত্যাকাণ্ডকে ৭১ এর গণহত্যার সাথে তুলনা করছে। এই বিষয়গুলিতে আমাদের সচেতন এবং দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রদর্শন জরুরী। মনে রাখা প্রয়োজন শাসক শ্রেণীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই মানুষের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসবে না। মানুষের মুক্তি আসবে প্রকৃতভাবে লুটপাট কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা তথা ব্যবস্থা বদলের মাধ্যমে। তাই অন্ধকার পেরিয়ে আলো আসবে কিনা সেটা নির্ভর করছে আজকের তরুণ প্রজন্মের উপর। নির্ভর করছে তারা কি শুধু কৌটার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি মানুষের সার্বিক সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তাদের রাজনৈতিক জীবনকে প্রবাহিত করবে তার উপর। লড়াইর ময়দান থেকে পলায়নপর প্রবাসী এক রাজনৈতিক কর্মী বাংলাদেশের লাখো তরুণ প্রজন্মের উপর আমি এখনো বিশ্বাস রাখতে চাই। আশা করি তারা তাদের সঠিক পথটি চিনতে ভুল করবে না। এই কঠিন সময়ে মা মাটি মানুষ আর স্বদেশের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর বুক ভরা ভালবাসা ছাড়া আমাদের আর দেবার কি আছে।।

You might also like