কেমন করে বেঁচে আছি এই করোনায়: পর্ব-৪
দিলীপ মজুমদার
আজ আঠারোই অক্টোবর।আর কয়েক দিন বাদে পুজো।এবারের দুর্গোপুজো একটু অদ্ভুত । সেপ্টেম্বর মাসে মহালয়া হয়ে গেল।তার এক মাস বাদে পুজো।করোনার আবহে পুজো কেমন হবে কে জানে !এর মধ্যে চলে গেল আমার দুই বন্ধু।সহপাঠী পার্থ চৌধুরী।আর সহকর্মী শক্তি ঠাকুর ।পার্থের মৃত্যুর খবর জেনেছিলাম এক বন্ধুর ফোনে।শক্তির মৃত্যুর খবর জানলাম খবরের কাগজ থেকে।করোনার আবহে কী ভাবে তাদের শেষকৃত্য হল জানি না।তারা করোনায় আক্রান্ত হয় নি।কিন্তু করোনার আবহে শেষকৃত্যে নিশ্চয়ই আত্মীয়-বন্ধুরা উপস্থিত হতে পারে নি ।
গত কয়েক মাস এই ভয়টা খুব ছিল।কিছু অঘটন ঘটে যাবার ভয় ।আমার বা আমার স্ত্রীর শরীর যদি খারাপ হয়,করোনার লক্ষণ যদি দেখা যায়, কী করব!ছেলে-মেয়ে দূরে থাকে, কে আমাদের নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে !চেনা-জানা ডাক্তার আছেন বটে, কিন্তু সংক্রমণের ভয়ে গুটিয়ে আছেন তাঁরা ।স্বাভাবিক।ফোনে ফোনে চিকিৎসা হচ্ছে।ফোনে ফোনে পড়াশুনোর মতো ।এবারের পুজোটা অন্যবারের মতো নয় ।যেন মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে । গত বারের পুজোয় ভালো ব্যবসা করেছিল আমার ছেলে।এবারের পুজোয় সে রকম ব্যবসা হলে ব্যাঙ্কের দেনা শোধ করে লভ্যাংশ থাকত ।কিন্তু মার্চ থেকে বন্ধ বিক্রিবাটা । ঘরভাড়া, কর্মচারীদের মাইনে সব ঘর থেকে দিতে হচ্ছে ।লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে গেল । তার উপর ছেলে আর ছেলের বউএর করোনা হল । প্রায় মাসখানেক গৃহবন্দি থাকতে হল । প্রথমটা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল ।খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল ।এখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে । কাপড়ের দ্বিস্তর মাস্ক তৈরি শুরু করেছে । অনলাইনে অর্ডারও
আসছে কিছু । হতাশা আমার মেয়েকেও আচ্ছন্ন করেছিল ।সে বাইপাশের ধারে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কো-ক্যারিকুলার টিচার । অভিভাবকরা ছাত্র-ছাত্রীদের ফিজের ব্যাপারে আন্দোলন শুরু করেছেন । তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছু টিচারকে ছাঁটাই করতে পারেন । কোপটা কো-ক্যারিকুলার টিচারদের উপর আগে পড়তে পারে বলে মেয়ের আশঙ্কা । অথচ তারা অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করে গেছে । এদিক থেকে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা দিব্যি আছেন, তাঁদের ছাঁটাইএর আশঙ্কা নেই । বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মতো এত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় না । সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের এই বৈষম্য কবে দূর হবে কে জানে !প্রথম দিকে সময় কাটানোর সমস্যা ছিল । লাইব্রেরিগুলো সব বন্ধ । ন্যাশনাল লাইব্রেরি, রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরি, বেহালা টাউন লাইব্রেরি, পাড়ার পর্ণশ্রী ক্লাব পাঠাগার সব বন্ধ । ইন্টারনেট অবশ্য চালু ছিল । মস্ত সুবিধে । টুকটাক নানা তথ্য নেট সার্চ করে পেয়ে যাব । এপ্রিলের পর থেকে ঠিক করলাম করোনার ডায়েরি লিখে যাব ।
মাস তিনেক সেটা করে যেতে মনে হল রাম মন্দির আর বাবরি মসজিদের ইতিহাসটা শেয করা দরকার । কেদারনাথ মজুমদারের ‘রামা্যণের সমাজ’ সম্পাদনা করার সময় থেকে সে চিন্তা মাথায় ঘুরছিল । এরই ফাঁকে বেশ কয়েকটা পুজো সংখ্যা পড়ে ফেললাম । একজন প্রসিদ্ধ লেখক করোনা সংক্রমণ নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন । বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখলাম সে উপন্যাসে তিন-চারটি অবস্থাপন্ন মানুষের সমস্যার কথা আছে । এ দেশের বেশির ভাগ মানুয অবস্থাপন্ন নয় । তারা কেমন করে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে, সে কথা কে লিখবে ? কবে লিখবে ?পুজো আসছে । আরও একটা কারণে ভয় জাগছে । মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন সেপ্টেম্বরে করোনা চলে যাবে । না, যায় নি ।
শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে করোনা বহাল তবিয়তে আছে । কলেবরে বাড়ছে । এ অবস্থায় উৎসবের ভিড়ে সংক্রমণ বাড়তে পারে । দেখা গেছে ইউরোপে চার্চের সমাবেশে, তবলিগি জমায়েতে করোনা বেড়েছে । যে কেরল প্রথম দিকে করোনাকে বাগে এনেছিল, ওনাম উৎসবের পরে সেখানে সংক্রমণ দ্রুতহারে বেড়েছে । আমাদের শারদোৎসব করোনাকে পুষ্ট করবে বলে আশঙ্কা আছে । তবে আদালত কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছেন । কিন্তু হুজুগে মানুষ কী তাতে দমবে ! কেরলের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন । বলেছেন উৎসবের জমায়েতকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই । এ অবস্থায় রাজনৈতিক সমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল তো চলছে । শাসক দলের ও বিরোধী দলের অনেকে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন । তাতেও দমেন নি তাঁরা । সমাবেশ চলছে চলবে । গালাগালি ও গলাগলি চলছে চলবে । দলবদল চলছে চলবে ।
আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রক আশার বাণী শুনিয়ে দিয়েছেন । বলেছেন দেশ সংক্রমণের
শিখর পেরিয়েছে । আক্রান্ত ৬৪ লক্ষ, মৃত ১ লক্ষের মতো । তার মানে আর ভয় নেই । এ আশার বাণীতে মন ভরে না । যেমন মন ভরে না এইমসের ডিরেক্টর রণদীপ গুলেরিয়ার কথায় । যেমন তাঁর মতে সব ঠিক থাকলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এসে যাবে টিকা ।
ইউরোপে বাজছে বিপদঘন্টি । চেক প্রজাতন্ত্র জুন মাসে ‘ফেয়ারওয়েল কোভিদ পার্টি’র আয়োজন করেছিল । যাকে বিপদ জানিয়েছিল সে নিশ্চয়ই মুচকি হাসছিল । কারণ দেখা গেল সেই ফেয়ারওয়েল পার্টির পরে সেখানে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল । জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় একটা সমীক্ষা করে জানিয়েছে দৈনিক মাথাপিছু সংক্রমণের হার এখন আমেরিকা থেকে বেশি বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ব্রিটেন, স্পেন ও ফ্রান্সে । এদিকে আবার জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে মাস্কবিরোধী বিক্ষোভ ।
এর মধ্যে শুনলাম ‘দ্য গ্রেট ব্যারিংটন ডিক্লারেশনে’র কথা ।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডিমিয়োলজিস্ট সুনেত্রা গুপ্ত, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের এপিডিমিয়োলজিস্ট জয় ভট্টাচার্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক মার্টিন কার্লডফ তৈরি করেছেন এই ঘোষণাপত্র । তাঁরা বলছেন, লকডাউনে কোন সামাধান নেই, বরং এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে ; বরং বয়স্কদের সাবধানে রেখে, অন্য রোগে আক্রান্তদের সাবধানে রেখে, বিধি মেনে অর্থনীতি নর্মাল করতে হবে ।স্বাভাবিক স্রোতে অর্থনীতিকে প্রবাহিত না করতে পারলে মানুষের রুটি-রুজির সমাধান হবে না ।গরিব মানুষ তো বলতে শুরু করেছেন, কঠোর বিধি-নিষেধ মানলে আমাদের ক্ষুধার অন্ন পাব কিভাবে ?
সেই জন্য নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘বিশ্ব খাদ্যকর্মসূচি’কে শান্তি পুরস্কার দিয়ে বলেছেন, খাবারই এখন একমাত্র ভ্যাকসিন ।খাবারের কথায় মনে পড়ল ডাঃ পরাগের কথা । তিনি বলেছিলেন, এ সময় ইমিউনিটি বাড়াবার জন্য মাছ-মাংস-ডিম এসব পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে । যাদের ভাতই জোটে না, তারা পুষ্টিকর খাবার পাবে কোথা থেকে ?
ডাঃ পরাগ আরও বলেছিলেন, হাইডক্সিক্লোরোকুইনের একটা ডোজ নিয়ে নিলে ভালো হয়; আমরা সবাই নিয়েছি ।কিন্তু সে ডোজ নেবার পরেও ডাঃ পরাগ করোনায় আক্রান্ত হলেন । যে সব ওষুধের কথা মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে, সেসব কার্যকর হচ্ছে না । গত মে মাসে মার্কিন ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থা গিলিয়াড সায়েন্সস-এর অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ রেমডেসিভিয়ার জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয় মার্কিন ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যাডমিনিস্ট্রেটসন’ । ভারতসহ বহু দেশ সেটার প্রয়োগ শুরু করে । বিশ্বের ৩০টি দেশের ১১ হাজারেরও বেশি আক্রান্তকে দেওয়া হয় । কিন্তু তাতে যে কাজ হচ্ছে না সে কথা কবুল করেছেন হু । কাজ হচ্ছে না ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন অথবা এইচ আইভির ওষুধ লোপিনাভিয়ার কিংবা ইন্টারফেরনে ।টিকার জন্য হাপিত্যেশ করে প্রহর গুনছে মানুষ ।কিন্তু টিকার দেখা নাই গো নাই ।
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।