পথের গল্প
রেনু লুৎফা
সুপারভাইজিং মিটিং চলাকালে সহকর্মী হেলেন বোমা ফাটিয়ে ঘোষণা দিলেন তিনি পদত্যাগ করতে চান। তার এই ঘোষণায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার আক্ষরিক ভাবার্থ টের পেলাম। আমাদের সময় ভাল যাচ্ছে না। সকাল বেলার মিটিংটিও ভালো যায়নি। নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রিন্সিপালের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। ৫ সেন্টার মিলে একসাথে মোট ৯ জন নারী কর্মচারী মেটারনিটি ছুটির আবেদন করেছেন!
এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, তিনি মনে করছেন এটা তাকে বেহাল করার ইচ্ছেকৃত পদক্ষেপ। মানুষ দিশেহারা হলে অনেক কিছুই বলে, আমরা তাই কোন ভ্রক্ষেপ করলাম না। তবে চকিতে একে অন্যের চোখের ভাষা পড়তে ভুল করলাম না। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। নতুন প্রিন্সিপালের প্রতিদিনের নতুন নতুন নিয়ম কানুনের সাথে কেউ পেরে উঠছেন না। বিদায়ী প্রিন্সিপালের দীর্ঘ ২৭ বছরের যে টীম স্পিরিট ছিল তা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। সকলেই আন্দাজ করছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।তবে কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না। প্রচুর ছাটাই চলছে।ইতিমধ্যে অনেকেই চাকুরী ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা যারা পুরানো স্টাফ, ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারা শক্ত অবস্থান থেকে নড়তে রাজী হলাম না।
কিন্তু হেলেনের পদত্যাগ করার বিষয়টি আমি কোন মতেই আমার মাথায় ঢুকাতে পারছিলাম না। হেলেনের বয়স তখন ৫৩। সে এই বয়সে এসে একটি স্থায়ী চাকুরী ছেড়ে দিতে চাইছে!
কিন্তু হেলেন নিশ্চিত। বাড়ির মর্গেজ শেষ হয়ে গেছে। বাড়তি কোন দায়িত্ব নেই। ছেলে মেয়ের দায়িত্বের সীমাও ডিংগিয়েছে। আর এই মূহুর্তে যদি চাকুরী না ছাড়েন তবে আর কোনদিন ছাড়তে পারবে না। আমি হেলেনের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করি, কিন্ত ব্যার্থ হই। তার সাহসের তারিফ করি। পরিস্থিতি সহায়ক না হলে হা হুতাশ না করে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে নতুন করে আকাশ দেখার চেষ্টা করতে হয়।
আয়ারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হেলেন চার বছর বয়সে মায়ের সাথে লন্ডন এসেছিলেন। নর্থ লন্ডনের ফিন্সব্যারী পার্কে বড় হয়েছেন। লেখাপড়া করেছেন লন্ডন আর ব্রিস্টল মিলে।
সেই চার বছরের শিশু চোখে প্রতিদিন অবাক বিষ্ময়ে দেখতেন ফিন্সব্যারী পার্ক স্টেশনের বাহিরের ফ্লরিষ্ট মহিলাটিকে। নানা রংগের বাহারি ফুল নিয়ে তার সে কি সুখের ছবি। হেলেন অবাক চোখে তা দেখতেন আর মনে মনে কল্পনা করতেন তিনি বড় হয়ে একদিন ফ্লরিস্ট হবেন। নানা জাতের ফুলের ডিজাইন করবেন। বড় হয়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিলেও শিশুকালের স্বপ্নটি অতি যতনে লালন করে রেখেছেন। আমাদের সকল উৎকন্ঠা আবেগ অনুভূতির প্রতি দরদ দেখালেও অবশেষে তিনি চাকুরী ছেড়ে দিলেন। তবে কথা দিলেন ঠিকতে না পারলে চলে আসবেন। এবার তার ফ্লরিস্ট হবার সময়।
১৮ মাসের মাথায় হেলেন ফিরে এলেন! ততোদিনে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ৩ টি সেন্টার বিক্রি করে একজিকিউটিভ দের বেহিসাবী দেনা শোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। নতুন নাম নিয়েছে। পুরানো একজিকিউটিভরা জীবনে আর কোন একজিকিউটিভ পদ নেবেন না বলে মুছলেখা দিয়ে জেলে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
হেলেন তার শিশুকালের স্বপ্ন পূরণ করে ফিরে এসেছেন। তার কোন অপ্রাপ্তি নেই এখন।
ফিরে এসেছেন শিক্ষককতা পেশায়। জাত শিক্ষকরা শিক্ষকতা ছেড়ে থাকতে পারেন না। মনে মনে ভাবি একজন মানুষ কতটা শুদ্ধ হলে শিশুকালের লালিত স্বপ্ন পূরণ করার অমন সাহস দেখাতে পারেন!?
রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ