পথের গল্প
রেনু লুৎফা
২০০০ সালে আমাদের সাথে যোগ দিলেন এক নতুন ইরিত্রিয়ান সহকর্মী। টিমের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য। দারুণ করিৎকর্মা। জন্ম ইরিত্রিয়ায় হলেও লেখাপড়া করেছেন ইটালীতে। ইরিত্রিয়া ইস্ট আফ্রিকার একটি দেশ।একসময় ইটালির কলোনী ছিল। ইটালিয়ান সরকারের বদান্যতায় লেখাপড়া শেষ করে অবশেষে লন্ডনে এসে আবাস গড়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি টিমের একজন জনপ্রিয় সদস্য হয়ে উঠলেন। ইটালিয়ান দের গালগল্প রপ্ত করেছেন বেশ। জমিয়ে আড্ডা দিতে জানেন। ইতিপূর্বে আমাদের টিমের কারোই ইরিত্রিয়ান সমাজ সভ্যতা সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না। সে সময়ে টিম বিল্ডিং ফিল্ডট্রিপ নামে আমাদের একটি ফান্ড ছিল(এখন আর নাই)। বছরে দুটো ট্রিপের ব্যবস্থা ছিল। এই ট্রিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল একে অন্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। নতুন নতুন চিন্তা ভাবনার সুত্র খুঁজে বের করা। টিমের মধ্যে কোন ধরনের তিক্ততা থাকলে তার নিরসন করা।আমাদের সহকর্মী টি দুই দিনে দুটি সেশন পরিচালনা করলেন। একটি ছিল তাদের ধর্মীয় এবং অন্যটি ছিল সমাজ ব্যবস্থা। নয়টি গোত্র নিয়ে দেশ তাদের। একেক গোত্রের ভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
সেইবার আমরা ইরিত্রিয়ান সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে জেনে নিজেদের সমৃদ্ধ করি। সেইটুকুই ছিল আমাদের ইরিত্রিয়ান জ্ঞান!
বছর খানেক পর আমাদের সহকর্মীটির মা মারা গেলেন। আমরা সবাই মিলে তাকে একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়ে শোকবার্তা জানালাম।
কয়েকদিন পরে তিনি আমাদের টিমকে তার বাড়িতে ডাকলেন তার মায়ের ফিউনারেল পরবর্তী অনুষ্ঠানে। আমরা গেলাম। অনেকটা আমাদের চল্লিশার মতো। লোকজন আসছে, যাচ্ছে, তার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে শোক জানাচ্ছে। খাবার দাবারেরও বন্দোবস্ত রাখা হচ্ছে। আমাদেরও খেতে ডাকা হলো, অজুহাত চললো না যেহেতু আগাম বলে দেওয়া হয়েছে। খাবার রুমের পাশেই একটি রুম। দরজা খোলা। ৫/৬ জন মহিলা নিলে কাঁদছেন। কাঁদা মানে শিশুদের হাত থেকে তার প্রিয়বস্তুটি কেড়ে নিলে যেমন কাঁদে এরা সেইভাবে কাঁদছেন। হাত পা ছুঁড়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন,এবং অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। আবাক হয়ে আমরা একে অন্যের দিকে চোখাচোখি করতেই আমাদের সহকর্মী টি বললেন এটি আমাদের স্পিরিচুয়াল কার্যক্রম।এরা কারা জানতে চাইলে বললেন এরা পেশাজীবি লোক এদের ভাড়া করে আনা হয়! এদের বলা হয় মিউটো(mutes)।বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। ইন্টারনেট ঘেটে দেখি এই কালচারটি শুধু আফ্রিকায় নয় বিভিন্ন নামে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ সহ চীন দেশেও আছে। ইউরোপের ইটালিতেও আছে। ।এদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। ঘন্টা হিসেবে এদের পরিশ্রামিক দেওয়া হয়ে থাকে। লন্ডনে এদের ভাড়া ঘন্টা হিসবে ক্ষেত্র বিশেষে ৪৫ পাউন্ড থেকে ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত। কি ধরনের বিলাপ চাইবেন সে হিসেবে তারা বিলাপ করবেন।
গতকালের ইংল্যান্ডের খেলা শেষে হঠাৎ করে ঐ বিলাপের স্মৃতিটি মনে পড়লো।