হিরোশীমা: কলঙ্কতীলক সভ্যতার,না এর তথাকথিত ঠিকাদারদের (ভিডিও)
সৈয়দ আনাস পাশা
হিরোশীমা থেকে ফিরে: হিরোশিমা জাপানের একটি শহর।এটি হিরোশিমা জেলার প্রশাসনিক রাজধানী এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় হুনশু দ্বীপপুঞ্জের ছুগোকু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর এবং জাপানের সর্ববৃহৎ দ্বীপ। জাপানের বর্তমান রাজধানী টোকিও থেকে ৫০০ মাইল দূরত্বের এই শহরে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকাল ৮.১৫ মিনিটে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরমাণু বোমার বিধ্বংসী পরীক্ষা চালানো হয়।
স্মৃতিস্তম্ভ
২৫ অক্টোবর’২০১৭, বুধবার হিরোশীমা পিস মেমোরিয়েল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় ৭২ বছর আগের সংঘটিত মানব ইতিহাসের সেই ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন দেখে অনেকেই অশ্রুশিক্ত হয়ে বের হচ্ছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম মানুষ হত্যার বীভৎসতম কাহিনী পৌছে দিতে মেমোরিয়েলে পরমানু বোমার ধ্বংসাবশেষের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষন করা হয়েছে।
পরমানু বোমায় বিধ্বস্থ ভবন
সভ্যতার ঠিকাদার দাবিদার আগ্রাসী বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার নির্দেশে হিরোশীমা ও নাগাসাকিতে পরমানু বোমা নিক্ষিপ্ত হলেও এই ধ্বংসযজ্ঞ সভ্যতার কলঙ্কতীলক হিসেবেই বিবেচিত হয় বিশ্বাবাসীর কাছে। নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয়ার ইচ্ছে থেকে সংঘটিত মার্কিন মোড়লদের এমন ধ্বংসযজ্ঞ মূলত তাদের কলঙ্কতীলক হলেও এই তীলক প্রতিনিয়ত পীড়া দেয় পুরো মানবসভ্যতাকে।মানবতাকে পদদলিত করে ক্ষমতার লোলুপতায় পৃথিবীতে মানুষের প্রান কেড়ে নেয়ার ঘটনা এখনও অহরহ ঘটলেও হিরোশীমা-নাগাশাকির মানবহত্যার বিভীষিকা এখনও তাড়া করে ফিরে মানবজাতীকে।
মেমোরিয়েলে সংরক্ষিত পরমানু বোমা ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন
মেমোরিয়েলে সংরক্ষিত পরমানু বোমা ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন
১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্টে সভ্যতার তথাকথিত ঠিকাদার আমেরিকা জাপানের হিরোশীমায় পরমানু বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার যে বীভৎস ঘটনার জন্ম দিয়েছিলো, সেই ঘটনার নিরব স্বাক্ষি হিরোশীমা পিস মেমোরিয়েল। এই মেমোরিয়েলে রক্ষিত সেই ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন দর্শকদের এখনও কাঁদাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মেমোরিয়েলের পাশেই এখনও দাড়িয়ে আছে পরমানু বোমায় বিধ্বস্থ একটি ভবণ। আছে স্মৃতিস্তম্ব, প্রতিদিন যেটিতে ফুল দিয়ে বোমায় নিহতদের স্মরণ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত দর্শনার্থীরা।
মন্তব্য বই:বোমা নিক্ষেপকারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যত ঘৃনা
১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকালে আমেরিকার যুদ্ধ বিমান থেকে হিরোশীমার বুকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো আনবিক বোমা। এর সঙ্গেই ছিল অগুনিত মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা। মুহূর্তেই থেমে গিয়েছিল হিরোশীমায় মানুষের চঞ্চলতা – লাশের আর রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন দেহে পাহাড় হয়ে যায় জাপানের হিরোশীমা। আগ্রাসনের উদগ্র মানষিকতার নিষ্ঠুর নির্মমতার ঘটনার ক্ষত চিহ্ন বয়ে চলেছে এই পৃথিবী এখনও। ‘লিটল বয়’ নামের ঐ নিউক্লিয়ার বোমায় ৪৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ১ লক্ষ চল্লিশ হাজার মানব সন্তান। এর তিনদিন পর নাগাসাকি শহরে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের আরেকটি নিউক্লিয়ার বোমার বিষ্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা।এখানে মৃত্যুবরণ করেন আরও ৭৪ হাজার মানুষ। তাৎক্ষনিক ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর পরও বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত রোগে জাপানের এই দুই শহরে পরবর্তীতে মারা যান আরও প্রায় ২ লক্ষ ১৪ হাজার মানব সন্তান। জাপানের আসাহি শিমবুন-পত্রিকার করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
যারা পরমানু বোমা বিস্ফোরণস্থলের সামান্য কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন, বিস্ফোরণের দুই সপ্তাহের মধ্যে যারা বিস্ফোরণস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন এবং যারা বিস্ফোরণ নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তায় ছিলেন আক্রান্ত এরা এবং এই তিন অবস্থার মধ্যে থাকা গর্ভবতী মহিলারা জাপানের ‘দ্য অ্যাটমিক বোম্ব সারভাইভারস রিলিফ’ আইন অনুযায়ী ‘হিবাকুসা’। জাপানী শব্দ ‘হিবাকুসা’ মানে বিষ্ফোরণ আক্রান্ত মানুষ।২০০৫ এর মার্চ পর্যন্ত এরা সংখ্যায় ছিলেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৮। হিবাকুসারা পেয়ে থাকেন সরকারি সহায়তা। অনুদান হিসেবে কিছু অর্থ দেওয়া হয় প্রতি মাসে। প্রতি বছর বিস্ফোরণের বার্ষিকীতে স্মরণ করা হয় নিহতদের। প্রতি বছর বিগত বছরে মৃত্যুবরণকারী ‘হিবাকুসা’দের নাম লিখে দেওয়া হয় হিরোশিমা-নাগাসাকির বুকে, মার্কিন বোমার তেজস্ক্রিয়তায় ঝলসে যাওয়া নিহতদের স্মৃতিফলকে। দীর্ঘ হয়ে ওঠা এ তালিকা বহন করে চলেছে মার্কিনি ‘সভ্যতা’র কুৎসিত ক্ষতচিহ্ন।
বিধ্বস্থ একটি কাঠের ঘর
হিরোশীমা পিস মেমোরিয়েলে ঢুকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বের হননি, এমন দর্শকের সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন দেশের দর্শক ছাড়াও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধানে জাপানের স্কুল ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিনই ঘুরে ঘুরে দেখছেন তাদের পূর্ব প্রজন্মের রক্ত ঝড়ানো মানব ইতিহাসের বিভৎসতম ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন।যুদ্ধবাজ আধিপত্যবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনা ও ক্ষোভ উজার করে মোরিয়েলের মন্তব্য বইয়ে প্রতিদিন শত শত দর্শক লিখছেন তাদের মনের কথা।আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সীমা বিস্তৃতির লক্ষ্যে পৃথিবীতে মানব নিধনের রক্তরঞ্জিত ঘটনা এখনও ঘটছে।এসবে হিরোশীমার মতো কাহিনী যাতে আর রচিত না হয়,শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর এমনটিই প্রার্থনা।
লেখক: সাংবাদিক, সত্যবাণীর সম্পাদক
https://www.youtube.com/watch?v=cYU25c0i1BY&feature=emb_title