ইংল্যান্ডের স্থানীয় নির্বাচনের ব্যবচ্ছেদ


 

ডা: জাকি রেজওয়ানা আনোয়ারএফআরএসএ

 

এই লিখা যখন লিখছি তখন ইংল্যান্ডের স্থানীয় নির্বাচনের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ গণণা শেষ হয়েছে। সব স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলকে একই ফর্মূলায় ফেলে ব্যবচ্ছেদ করা সঠিক কাজ নয়, স্থান কাল পাত্র ভেদে এর ব্যবচ্ছেদও করতে হবে ভিন্নভাবে। ফলাফল আসতে শুরু ‌‌‌করেছে তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসে যাচ্ছে। প্রথমত: এবারের স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল আমাদের কি বার্তা দিচ্ছে; দ্বিতীয়ত এই ফলাফল থেকে আসছে সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা কি আঁচ করতে পারি ; তৃতীয়ত: এই ফলাফলের পর কনজারভেটিভ দলের মধ্যে নতুন কোন্ নাটক শুরু হবে‌ এবং চতুর্থত: ঋষি সুনাকের এখন  কি করা উচিত এবং কি করা অনুচিত।
 প্রাথমিক গণণায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, লেবারের ৪০০টি আসনে নেট গেইনের পূর্ব ঘোষণার চাইতে বেশীই ভোটই তারা পাবে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিজয় হয়েছে প্লিমাথ, ষ্টোক ও মিডওয়েতে। লেবারের ষ্টোক দখলকে আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, কিয়ার ষ্টার্মারের নেতৃত্বের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল যেসব অঞ্চল আগে লেবারের দখলে ছিল কিন্তু ব্রেক্সিটকে সমর্থন করতে গিয়ে ২০১৯ সালে তারা কনজারভেটিভকে ভোট করেছিল সেই সব অঞ্চলগুলোকে পুনরুদ্ধার করা। ষ্টোক শুধুমাত্র ব্রেক্সিটকে সমর্থন করতে গিয়ে ২০১৯ সালে লেবারের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ষ্টৌকের বিজয় আগামী সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে যে স্পষ্ট বার্তাটি দিচ্ছে তা হচ্ছে, ব্রেক্সিটের পক্ষে বা বিপক্ষে যে অবস্থানেই থাকুক কেন আগামী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ ভোট করবে মূলত দু’টো বিষয়ের উপর: জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পাবলিক সার্ভিসের মানের উপর। ছোট নৌকার বিষয়টি খুব বেশী প্রাধান্য পাবেনা। অথচ ঋষি সুনাক স্থানীয় নির্বাচনের আগে এবং প্রাথমিকভাবে ভোট গণনার পরেও বার বার ছোট নৌকার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন।
গত এক শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথমবারের মত কনজারভেটিভ হার্টসমেয়ার বারা কাউন্সিলে‌ তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারাল। কিছু কিছু কাউন্সিলে যেমন ব্রেন্টওড,  ব্রডল্যান্ড – যেসব জায়গা আগে যেগুলো কনজারভেটিভের দখলে ছিল সেসব জায়গায় এখন কোনো দলেরই সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই। অর্থাৎ এই অঞ্চলের মত অনেক অঞ্চলেই
ভোটাররা মোটামুটিভাবে বড় দলগুলোর কোনোটির উপরই ভরসা না করে যিনি রাস্তার গর্ত মেরামত করবেন বা নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কার করাবেন সে সবের উপরই ভিত্তি করে আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রধান‌ দলগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবে। কাজেই এ ধরনের অঞ্চলের দিকে লেবারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
লিবডেমেরর জন্যে এবারের স্থানীয় নির্বাচনের সব চাইতে ইতিবাচক দিক হতে যাচ্ছে, তারা ব্লু ওয়ালের যেসব অঞ্চল কনজারভেটিভের দখলে ছিল সেসব ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ অঞ্চলের দখল নেওয়া অর্থাৎ এখানে কনজারভেটিভের জন্যে স্পষ্ট বার্তা হচ্ছে ব্লু ওয়ালের যেসব অঞ্চল রিমেইন ছিল কনজারভেটিভ তাদের পুনরুদ্ধার করতে ব্যার্থ হয়েছে।

তবে কনজারভেটিভের অনেক আসন লেবারের কাছে না গিয়ে লিবডেমের কাছে গিয়েছে – এই ভেবে লিবডেমের খুব বেশী তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না এ কারণে যে, যারা স্থানীয় নির্বাচনে লেবারকে ভোট না দিয়ে লিবডেমকে ভোট দিয়েছে তাদের অনেকেই সাধারণ নির্বাচনে লেবারকে ভোট করবে। সাধারণত স্থানীয় নির্বাচনে যেভাবে লিবডেম ভাল করে সাধারণ নির্বাচনে সেভাবে করেনা। তার প্রধান কারণ হচ্ছে বেশীরভাগ ভোটার স্থানীয় নির্বাচনে যাকেই ভোট করুক  সাধারণ নির্বাচনে প্রধান দু’টো দলের একটিতে ভোট দিয়ে থাকে।
লিবডেম ২০১৯ সালের চাইতে ভোট বেশী পাবে বলে মনে হচ্ছে এবং ২০১০ সালে কোয়েলিশন সরকারে যাবার পর এবারই হয়তো সব চাইতে বেশী ভোট পাবে। তবে লিবডেমের জন্যে এটা গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে যে,‌‌ যেসব জায়গায় তারা কনজারভেটিভের কাছ থেকে ভোট ছিনিয়ে আনতে পেরেছে অর্থাৎ যেসব জায়গায় ভোটারদের তৃতীয় পছন্দের দল লেবার ছিল, তাদের কাছ থেকে লিবডেম কতটা ভোট ছিনিয়ে আনতে পেরেছে। তা যদি না হয়  তাহলে লিবডেমের আগামী সাধারণ নির্বাচনে দারুণ ফলাফল করার আশা ততটা উজ্জ্বল নয়।
এই স্থানীয় নির্বাচনে জনগণ  আরও একটি বার্তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে যাচ্ছে যে, ব্রেক্সিটের ফল ভাল হোক আর মন্দ হোক ব্রেক্সিট সংক্রান্ত কোনো টোপেই তারা আর আগ্রহী নয়, অর্থাৎ জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পাবলিক সার্ভিসের মানকে জনগণ এখন এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে এ দু’টো বিষয় জনগণকে যতটা ভাবিত করছে  ব্রেক্সিট বেদনা আর তাদেরকে তেমনভাবে ভাবিত করছে না এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে এই বেদনা আরেকটু অতীত ঘটনায় পরিণত হবে। সে কারণেই যে দলই ব্রেক্সিটকে পুঁজি করে রাজনীতি করছিল যেমন ইউকিপ, রিইফর্ম ইউকে তারা মোটামুটিভাবে ধূলোর সঙ্গে মিশে যাবে সে বিষয়টি মোটামুটিভাবে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ এবারের স্থানীয় নির্বাচনে জনগণ এটি অন্ততঃ বুঝিয়ে দিল যে ব্রেক্সিটকে এখন আর কেউ প্রাধান্য দিচ্ছেনা, অর্থাৎ আবার গণভোটের টোপকেও জনগণ আর আমলে আনবেনা।
স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল সব সময় সাধারণ নির্বাচনের একেবারে খুব ভাল ইন্ডিকেটর হয়না । কারণ স্থানীয় নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডের মধ্যে নির্বাচন হয়, কাজেই সেখানে অনেকেই বড় রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর কথা এক পাশে রেখে একেবারে স্থানীয় ইস্যুগুলো বিবেচনা করে ভোট‌ দেয়, সেই সাথে কাউন্সিলরদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি একেবারে কাজ করে না তাও নয়। তবে যদি সমগ্র বৃটেন নীল অথবা লাল হয়ে যায় তখন আর তাকে ‘মিড টার্ম ব্লু’ ব’লে খারিজ করে দেওয়া যায়না। যেমন টনি ব্লেয়ার সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগের স্থানীয় নির্বাচনে গোটা বৃটেনের মানচিত্র লাল হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় নির্বাচনে এতটুকু বলা যায় যে, কোন দলের অবস্থান কেমন তবে কোনো দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে কিনা তা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ওয়ার্ড ওয়ারী কত ভোট কোন‌ দল পেয়েছে – কতজন কাউন্সিলর কোন দল‌ থেকে‌ নির্বাচিত হয়েছে শুধু তা দিয়ে নয়।
এ লিখা যখন লিখছিলাম তখনো পর্যন্ত দেখা গেছে ২০২২ সাল থেকে কনজারভেটিভ পাঁচ পয়েন্ট নীচে নেমেছে কিন্তু ভোটের অঙ্কে লেবারের নিজস্ব অংশীদারিত্ব সেই অনুপাতে বাড়েনি। কাজেই, এই প্রাথমিক ফলাফল থেকে লেবার আগামী নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে একেবারে একাই সরকার গঠন করে ফেলবে – এমন বার্তা নিশ্চিত ভাবেই দেওয়া যাচ্ছেনা যদি না কনজারভেটিভ আরো কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়। তবে সেক্ষেত্রেও কনজারভেটিভের হারিয়ে ফেলা সব ভোটই লেবার পকেটস্থ করতে পারবে এমন ধারণাও করাও ঠিক নয়। লেবার দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে এমন কথা ১৯৯৭ সালে নির্দ্বিধায় বলা গিয়েছিল কারণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর স্থানীয় নির্বাচনে তখন সর্বোচ্চ সুইং হয়েছিল । সেই মাত্রায় সুইং হবে বলে এবার বলা‌ যাচ্ছেনা।
আমরা যদি ২০১৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে দেখব তখন কনজারভেটিভ এবং লেবার উভয় দলই খারাপ করেছিল এবং তখন বলা হয়েছিল লেবার ও কনজারভেটিভ দুই বাড়ীই প্লেগ সংক্রমিত, তবে এবার শুধু একটি বাড়ীতেই প্লেগের সংক্রমণ হয়েছে – কনজারভেটিভের বাড়ীতে। সংক্ষেপে বলা যায়, এবারের স্থানীয় নির্বাচনে  একমাত্র কনজারভেটিভের ক্ষেতেই পোকা ধরবে, বাকী সবাই – লেবার, লিবডেম,‌‌‌‌‌‌ গ্রীন পার্টি প্রত্যেকের গোলায় ধান উঠবে তবে ইউকিপ, রিফোর্ম ইউকে মোটামুটিভাবে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা ভুল হবে না।

 

ঋষি সুনাকের এখন কি করণীয় আছে?

 

ঋষি সুনাকের সব চাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, তিনি ভুল‌ থেকে শিক্ষা নিতে জানেন না, এটা তার চরম দূর্বলতা। ঋষি সুনাককে প্রথমে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে প্রথমে মেনে নিতে হবে যে, তাদের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী তাঁর কন্ঠস্বরের কিঞ্চিৎ ফাইন টিউনিঙের প্রয়োজন। অথচ প্রাথমিক ফলাফলের পরেও‌ তিনি বলে-ই যাচ্ছেন, জনগণ চায় তিনি যা করছেন তা-ই যেন করতে থাকেন এবং ভরাডুবি টের পাবার পরেও তিনি ‘স্মল বোট’ এর‌ গপ্প থেকে সরে আসতে পারছেননা। অথচ বরিস জনসনের মত একরোখা রাজনীতিবিদকেও স্থানীয় নির্বাচনের পর বলতে শুনেছি যে, জনগণ কি বলতে চাইছে তা তিনি শুনতে পেরেছেন।  ঋষি সুনাক কি বুঝতে পারছেন না, দলের স্বার্থে তাঁর উচিত লস মিনিমাইজ করা বা ক্ষতি আর না বাড়ানো?
খুব শিঘ্রই কনজারভেটিভের অভ্যন্তরে যা ঘটবে তা হচ্ছে,  ক্যাবিনেট সেক্রেটারি সাইমন কেইস যাঁর আগেই পদত্যাগ করার কথা ছিল তিনি হয়তো পদত্যাগ করবেন। এছাড়া কনজারভেটিভের মধ্যে‌ জনসন ক্লাবের এমপিরা সুনাকের শির:পীড়ার উদ্রেগ ঘটাবে। সুনাকের নিজের দলের এমপিরাই উইন্সর ফ্রেমওয়ার্কের  ব্যাপারে সুনাককে এখন সহযোগিতা না করার কথা। সাধারণ নির্বাচনের আর‌ দেরী না করে কনজারভেটিভের জন্যে ভাল হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব‌ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে ক্ষতির পরিমাণ কমানো। সুনাক যত দেরী করবে কনজারভেটিভ  তত বেশী সংসদ আসন হারাবে এবং কনজারভেটিভের আবার ক্ষমতায় আসা তত বেশী পিছিয়ে যাবে। অনির্বাচিত সুনাক‌‌ তাঁর প্রথম পরীক্ষাতেই দলের এমপিদের কোনো আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারলেন‌না।  কাজেই সুয়েলা ব্রেভারমেনের ছোট‌ নৌকা থেকে নেমে এসে দলকে রক্ষা করা ঋষি সুনাকের প্রথম কাজ হবে এবং তা করা উচিত অতি দ্রুত।

 

লেখক:চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট 
You might also like