ঐতিহাসিক ১৪ ফেব্রুয়ারী ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস
এস এম সুজন
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথে,সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ইতিহাস গড়ে।সে দিন রাজপথকে রক্তে রঞ্জিত করেছিল।দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য সারথি। শ্রদ্বাঞ্জলি স্বরন করি। একুশে ফেব্রুয়ারী ৫২এর পর এটাই ছিল মাইল ফলক ছাত্র বিক্ষোভের এবং নির্যাতনের ইতিহাস।যখন এই নৃশংস ঘটনা ঘটে, আমি হাই স্কুলে ৬স্ট শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছি মাত্র। কিন্তু আমার আত্মীয় বড় ভাই ফুফাত সেলিম সিদ্দেকী ছাত্র ইউনিয়নের বড় নেতা,বড় ভাই মাসুক মিয়া চাচাত ছাত্রলীগ (জাসদ) এর নেতা উনাদের শ্নেহে ভালবাসায় উপদেশের মত শুনা ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে যতটুকু জেনেছি।
আমি যখন ৭ম শ্রেনীতে নতুন বাজার হাই স্কুল (ধারন) তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ স্কুল শাখার প্রতিস্টাতা সভাপতি এরই সুবাধে তথকালিন ছাত্রলীগের ফেরিওয়ালা হাবিবুর রহমান জালাল বর্তমানে সাংবাদিক ও পীর আমিনুল ইসলাম আং হক স্মৃতি কলেজ গবিন্দগন্জ ছাত্রলীগের মজলুম নেতা আং জলিল ছাতক থানা ছাত্রলীগের কারিগর কামরুজ্জামান স্হানীয় নেতা শামসুর রহমান বর্তমান এডভোকেট আওয়ামী লীগ নেতা, সুন্দর আলী বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী সহ অনেক নেতৃবৃন্দ থেকে শুনা। ৮৭ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ধারন বাজার আঞ্চলিক শাখার প্রতিস্টাতা সভাপতি এবং স্কাউট উপদল নেতা ও স্কুল ক্যাপটিন নির্বাচিত হই। ১৯৮৯ সালে সিলেট সরকারী ডিগ্রি কলেজে ভর্তির পর তখন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের নামে শ্লোগান শোনা যেতো। জাতীয় ছাত্রলীগের মিছিলে রাউফুন বসুনিয়া শ্লোগান জুড়ে সুরে শুনা যেত। তখনও বাম সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে যথেষ্ঠ শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ছিল। পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাধীদের শাসন সুশনের বিপক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিলতিল করে সুসংগঠিত করেছিলেন বাঙ্গালী জাতিকে শ্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাস্ট্র জাতীয়তা ও গনতন্ত্রের দীক্ষায়। সুযোগ্য নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় সফল মুক্তিযুদ্ধে, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দু’লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর, অমানুষিক নির্যাতন জ্বালাও পোড়াওর ধ্বংস্তুপের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের মূলমন্ত্রকে, শ্বাধীনতাকে ও পবিত্র সংবিধানকে বাইপাস করে বিপরীত দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
‘ক্যু-পাল্টা ক্যু’র মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে বাঙ্গালী জাতির আশা আকাঙ্খা। সামরিক শাসকদের পালা বদল হয় জিয়া থেকে এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ওই দিনই ছাত্ররা স্বত:স্ফুর্তভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সোচ্চার হয়।তিন দফা দাবিকে সামনে রেখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দাবিগুলো হলো( ১)মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, (২)সকল ছাত্র ও রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তিদান। (৩) সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতাদের ডেকে বললেন, অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্ররা প্রশ্ন করলেন কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় কেন্দ্রীয় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবন বাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঁধভাংগা ছাত্র-জনতা।স্বৈরাচারী শাসনকালে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলা থেকে শুরু হওয়া শিক্ষাভবন অভিমুখী মিছিলে পুলিশের নারকীয় হামলার শিকার হয় ছাত্ররা। স্বৈরাচারী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশবাহিনীর গুলিতে সেদিন জাফর- জয়নাল- কাঞ্চন- মোজাম্মেল- দিপালী সাহা সহ অনেক সংগ্রামী ছাত্র আত্মাহুতি দেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশি বাধায় সে মিছিল পন্ডু হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার গণ অভ্যুত্থান দিবসে, ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ কলাভবনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এই মিছিলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহ বহু ছাত্র-ছাত্রী আহত ও গ্রেপ্তার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণাঙ্গনে। দিনশেষে সিদ্ধান্ত হয় ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কখনো পুলিশ প্রবেশ করতে পারবে না। ক্যাম্পাস হয় মুক্তাঞ্চল।ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতিবাদী মিছিলে ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এরশাদ তার সন্ত্রাসিবাহিনী দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করায় মেধাবী ছাত্রনেতা রাউফুন বসুনিয়া সহ অনেক ছাত্র নেতাদের হত্যাকরে গুম করা হয়। ১৯৮৭ সাল ছাত্র আন্দোলন তুংগে ১০নভেম্বর নূর হোসেনকে মিছিলে এরশাদ পুলিশ বাহিনী দিয়ে হত্যা করে।বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখাছিল”স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” গণহত্যা দিবস।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর ও জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলি প্রিয় নেত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মানববেদী সৃস্টি করে নেতা কর্মীরা, বুক উজার করে লাল রক্তে কালো রাজপথে আতœাদান করে সেদিন-মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন কুমার বিশ্বাস, স্বপন চৌধুরী, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, শাহাদাত, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে , সমর দত্ত, হাসেম মিয়া ও মো. কাসেম।আহত হয় আরও প্রায় তিন শতাধিক নেতা কর্মী।
শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলির ঘটনা সেদিনের আন্দোলনে বারুদ ঢেলেছিল রাজপথে স্বৈরশাসক। ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনের দিকে যাচ্ছে উত্তাল রাজপথ ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের সন্ত্রাসীবাহিনী গুলি করে হত্যা করে ডাঃ শামসুল আলম খাঁন মিলনকে।ডাঃ মিলনের রক্তদান ছিল স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের এক টার্নিং পয়েন্ট। স্বৈরাচার পতনের তীব্র গণজোয়ার সৃষ্টি হয়।সারা বাংলাদেশে চড়িয়ে পড়ে আন্দোলন সিলেটে ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিস্টান সহ অলি গলিতে প্রতিবাদী ছাত্র জনতা।সুভাগ্য হয়েছিল মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার,আমি তখন সিলেট সরকারী ডিগ্রী কলেজ,ছাত্র সংসদের ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক ছিলাম।অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় দখলবাজ স্বৈরাচার এরশাদের। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা ও যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক।