কেমন করে বেঁচে আছি এই করোনায়: পর্ব-৩
দিলীপ মজুমদার
আজ দোসরা অক্টোবর। শুক্রবার। খবর পেলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তাঁর স্ত্রী মেলেনিয়াও আক্রান্ত। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওয়াল্টার রিড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই পাগলা দাশু খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন করোনাকে। জানুয়ারি মাসে তিনি বলেছিলেন করোনা খুব সামান্য অসুখ, গরম পড়লেই ভেগে যাবে করোনা। ফেব্রুয়ারি মাসে বললেন, ‘একদিন দেখবেন হঠাৎ চলে গিয়েছে করোনা। মিরাকল হয়ে যাবে।’ এপ্রিল মাসে একবার বললেন, ‘মুখ ঢাকার ওই নন-মেডিক্যাল কাপড়টা কেউ ইচ্ছে হলে পরতে পারেন। ওটা ভলান্টারি। পরতেই হবে এমন নয়। আমি তো পরব না, কিছুতেই না।’ সে মাসেই তাঁর দ্বিতীয় বচনামৃত, ‘শরীরে যদি ইউভি লাইট বা কোনও শক্তিশালী আলোকরশ্মি দিয়ে উত্তাপ দেওয়া যায়? কিংবা জীবাণুনাশক দিলে এক মিনিটে মরে যায়, স্রেফ এক মিনিটে। কোনও ইঞ্জেকশন দিয়ে শরীরে যদি জীবণুনাশক ঢোকানো যায়? বেশ পরিষ্কার হবে যাবে। পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।’ ফোর্ডের কারখানা সফরে তিনি বলেন, মুখে তিনি একটা মাস্ক পরেছিলেন বটে, কিন্তু সাংবাদিকদের সামনে সেটা পরে এসে মনোরঞ্জন করতে পারবেন না। ফক্স নিউজের অনুষ্ঠানে জুলাই মাসে তিনি জানিয়ে দিলেন মাস্ক পরলে সব কিছু চলে যাবে এ কথা তিনি মানেন না। আগস্ট মাসে হোয়াইট হাউসে বললেন মাস্ক পরাটা দেশাত্মবোধক কাজ। সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটে মাস্ক পরা নিয়ে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে বিদ্রুপ করে বলেন, ‘আমার কাছে মাস্ক আছে। যখন দরকার হবে তখন পরব। আমি জো বাইডেনের মতো সবসময় মাস্ক পরি না। যখনই দেখবেন ওঁকে, একটা মাস্ক পরে। হয়তো ২০০ ফুট দূর থেকে কথা বলছেন, তাতেও দেখবেন মুখে একটা এত বড় মাস্ক।’ পাগলা দাশু কারোরই পরামর্শ শোনেন না। বৈজ্ঞানিক আ্যন্টনি ফাউচিকেও তিনি অনায়াসে ‘ইডিয়ট’ বলতে পারেন। তাঁর অবিমৃশ্যকারিতায় আমেরিকায় করোনা সংক্রমণ এত ব্যাপক হয়েছে বলে অনেকের অভিমত।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ৭৫তম বার্ষিক সাধারণ সভায় করোনা সংক্রমণের জন্য ট্রাম্প চিনকে দায়ী করেছেন। চিনের সর্বাধিনায়ক শি চিনফিং এ কথার উত্তরে বলেন, ‘এই ভাইরাস দেখিয়ে দিল কোন রাষ্ট্র বা তার অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকতে পারে না। এর পরেও কেউ যদি উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকেন, তা হলে তা খুব দুঃখের হবে।’
রেকর্ড দৈনিক সংক্রমণ হয়েছে ফ্রান্সে। স্পেনেও বাড়ছে সংক্রমণ। মাদ্রিদে আবার লকডাউন। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউএর জন্য সতর্ক করে দিচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। হয়তো পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়ার জন্য ইউরোপে বিপদ বেড়েছে। শুরু হয়েছিল ব্রিটেনের বিচপার্টি। পাবগুলোয় বাড়ছিল ভিড়। ফ্রান্সের সেন নদীর তীরে উপচে পড়ছিল ভিড়। ভারতেও সংক্রমণ দৈনিক ১ লক্ষ ছুঁতে যাচ্ছে। ভারত সরকার অবশ্য সব দোষ চাপিয়ে দিতে চাইছেন তবলিগ জমায়েতের উপরে।
হিউস্টনের একদল গবেষকের মতে মিউটেশনের ফলে করোনা বেশি সংক্রামক হচ্ছে। তবে তার মরণক্ষমতার তারতম্য হয় নি। ভাইরাসের সফলতার মাপকাঠি যদি ট্রান্সমিশন হয়, তবে গত ১০০ বছরে কোভিদ ১৯ এর মতো সফল ভাইরাস পৃথিবীতে দেখা যায় নি। সে যেমন সফল, তেমনি রহস্যময়। প্রতিদিন আসছে নতুন নতুন তথ্য। সেগুলো আবার অনেক সময়ে পরস্পরবিরোধী। ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। এখন যেমন আঁকড়ে ধরতে চায় ফ্যাভিপিরাভিয়ার গোত্রের ওষুধকে। এই গোত্রের অ্যাভিফ্যাভি্যার ওষুধটি রাশিয়া থেকে নিচ্ছে আর্জেন্টিনা, চিলি, সৌদি আরব, পানামা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইকুয়েডর, কুয়েত, বেলারুস, বলিভিয়া, কাজাকস্তান, উজবেকিস্তান।
এদিকে টিকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে রাজনীতি। সাধারণ মানুষ ভাবছেন টিকা এল বলে। কিন্তু আগে যেসব সংক্রামক রোগ দেখা দিয়েছে পৃথিবীতে তাদের টিকা কী অল্প সময়ে পাওয়া গেছে? একবার সে দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। যেমন স্মল পক্স। মানুষের ইতিহাসের শুরু থেকে এ রোগটি দেখা দিয়েছে। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার এর টিকা আবিষ্কার করলেন।কিন্তু সারা বিশ্বে সার্বিকভাবে সে টিকার প্রয়োগ হল ১৯৬৭ সালে। যেমন প্লেগ। এটিও প্রাচীন রোগ। বিশ্বের ২০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ প্লেগ। এখনও এর টিকা আবিষ্কৃত হ্য় নি। সম্ভাব্য টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। যেমন টাইফয়েড। দঃ পুঃ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই রোগ। ১৯০৯ সালে ফ্রেডেরিক এফ রাসেল টাইফয়েডের টিকা আবিষ্কার করেন। কিন্তু সেই টিকা বাজারে আসে ১৯১৪ সালে। যেমন ইয়েলো ফিভার যা গত ৫০০ বছর ধরে পৃথিবীর আতঙ্ক। ১৯৫১ সালে ম্যাক্স টেলার এর টিকা আবিষ্কার করেন। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা। ১৯৩০ সাল থেকে টিকা আবিষ্কারের উদ্যোগ। ১৯৪৫ সালে টিকা আবিষ্কার হলেও দু বছর পর সে টিকা আর কাজে এল না। যেমন পলিয়ো। উনিশ শতকের শেষ থেকে এ রোগের দেখা মিললেও অ্যালবার্ট সেবিন ১৯৫৬ সালে আবিষ্কার করলেন টিকা। যেমন অ্যানথ্রাক্স, যা খ্রিস্ট পূর্ব যুগ থেকে ভোগাচ্ছে মানুষকে। ১৯৩৭ সালে মাক্স স্টার্ন আবিষ্কার করেন এর টিকা।
সুতরাং করোনার টিকা নিয়ে খুব আশাবাদী হতে পারি না। এখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা কোভিদের মুখোশ শিম্পাঞ্জির অ্যাডোনাভাইরাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করিয়ে তার ফলাফল পরীক্ষা করে দেখছেন। এই তত্ত্বের উপর করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সাফল্য নির্ভর করছে।
তাছাড়া, একদিন টিকা আবিষ্কৃত হলেও পৃথিবীর সব মানুষ যে তার সুবিধে পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের ৭৮১ কোটি মানুষের মধ্যে ২৩৪ কোটি মানুষ ভ্যাকসিন পাবে না। কোভ্যাক্স পরিসেবার মাধ্যমে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত ২০০ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ সুনিশ্চিত করা হয়েছে যাতে হাইরিস্ক ও ভালনারেবল এবং ফ্রন্ট লাইন হেল্থ ওয়ার্কারদের ভ্যাকসিন দেওয়া যায়।
এই পর্যন্ত লেখার পরে একটা চিৎকার শুনলাম। চিৎকার করে কে ডাকছে আমার স্ত্রীকে। বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের বাড়ির বউদি তিন তলা থেকে ডাকছেন। বড় করুণ আবস্থা তাঁর। অকালে সন্তান হারিয়েছেন। বছর কয়েক আগে স্বামীরও মৃত্যু হয়েছে। মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে বেঁচে আছেন। তারা তাদের জীবিকার টানে ব্যস্ত থাকে। দিনের অনেকটা সময় নিঃসঙ্গ থাকেন বউদি। তিনি সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করেন। এখন করোনার জন্য সে সব বন্ধ। বউদির বয়স হয়েছে। নানা রকম রোগ আছে। তাই তাঁর মেয়ে তাঁর বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। স্বাভাবিক। আমার বোনের বরেরও একই দশা। টুকটাক উত্তরপাড়ার বাজার থেকে ঘুরে আসত, ব্যাঙ্কে যেত, বিকেলে গঙ্গার ঘাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিত। ভাগনের কঠোর নির্দেশে সে সব বন্ধ। খবরের কাগজ পড়ে, টিভি দেখে সারা দিন কাটে না। করোনা সংক্রমণের ফলে বয়স্ক মানুষ আর শিশুদের খুব ক্ষতি হয়েছে। তারা কেমন খিটখিটে আর তিরিক্ষে হয়ে যাচ্ছে। অন লাইনে পড়াশুনো চালু হয়েছে বলে বাচ্চাদের হাতে স্মার্ট ফোন দিতে হয়। সেটা আবার আরেক বিপদ ডেকে আনছে। মোবাইলের ছবির মধ্যে বুঁদ হবার নেশা বেড়ে যাচ্ছে।
করোনা নানা সমস্যা ডেকে এনেছে। তার মধ্যে মানসিক আর অর্থনৈতিক সমস্যা প্রধান। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে চলেছেন। ২০২০ সালের শেষেই ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ সে সংকটে পড়বেন। তাই রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি ধনকুবেরদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু বরফ খুব বেশি গলবে না। এই অসাম্য করোনার চেয়ে বড় অসুখ আর কি হতে পারে।
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।