ডাঃ শিশির,ও তার গেরিলা যুদ্ধের গল্প

জুয়েল সাদাত

ডাঃ সিরাজুল ইসলাম। একজন অসাধারন মানবিক মানুষ। একজন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেইনার। ১৪০০ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনিং করেিযেছেন। শিশির ভাদুড়ী ছদ্ব নামে গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। অসাধারন দেশপ্রেমিক একজন চিক্যিসক মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের দুই ভাই যুদ্ধ করেছেন। ধার্মিক পরিবারে বেড়ে উঠা ডাক্তার ইসলাম তাবলিগের দাওয়াত নিয়ে সারা আমেরিকার মসজিদে মসজিদে কাটিয়েছেন। অসাধারন গান গাইতে পারতেন। ওস্তাদের কাছে গান শিখেছেন। দাওয়াতি কাজে জড়িয়ে গান ছাড়েন। ফ্লোরিডায ৬/৭ টি মসজিদ তৈরী করেছেন। দান করেন হিসাব ছাড়া। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু,শেখ হাসি নান,r নিয়ে কোন আপোষ করেন না। ছিলেন মরহুম শেখ কামালের বন্ধু। একাধারে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর ব্যাক্তিগত চিক্যিসক।

মন খুলে যুদ্বের গল্প, জীবনের গল্প, নিয়ে কথা বলেছেন কমিউনিটি একটিভিষ্ট সাংবাদিক কলামিষ্ট জুয়েল সাদতের সাথে।

জুয়েল সাদাত – আপনার পড়াশুনা বা ছাত্র জীবন কেমন ছিল?

ডাঃ শিশির – নাটোরের গুরুদাসপুরে প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর পাবনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করি। স্কুল জীবনে স্কাউট লিডার, আবৃত্তি, লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিলাম। তারপর ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করি। তারপর ফাস্ট গ্রেট স্কলারশিপ নিয়ে আমরা মাত্র দুজন ইষ্ট পাকিস্তান থেকে লাহরে যাই। ঢাকা কলেজে পড়াশুনা কালীন সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কলেজের ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারী হই। তখন মরহুম শেখ কামাল আমার সহপাটি ছিলেন। তিনি বলতেন তোমরা মেধাবী পড়াশুনা করো। প্রযোজন মতো আমাদের সাপোর্ট কর। তিনি আমার নির্বাচনে আমাকে ভোট দিতে বলতেন সবাইকে। লাহোরে পড়াশুনার জন্য্ যাই ১৯৬৯ সালে তারপর যুদ্বের কারনে সেখানে থাকা সম্ভব না হওয়ায় ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশে যুদ্বচলাকালীন চলে আসি। যুদ্ধের পর ঢাকা মেডিক্যাল্ থেকে ডাক্তারী পাশ করি।

জুয়েল সাদত – আপনার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সম্পর্ক জানতে চাই?

ডাঃ শিশির – পাবনা জেলা স্কুলেই আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়ানো। লেখালেখি,স্কাউটিং এর নানা একটিভিটিস, গল্প কবিতা নাটক সব কিছু শুরু স্কুল জীবনেই। তারপর ঢাকা কলেজে বড়ো পরিসরে জড়ানো। ঢাকা কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অতপ্রতভাবে জড়িত ছিলাম। সব গুলো স্টেজ শোতে আমি থাকতাম। নাটক করতাম। ঢাকার অগ্নিবনাতে জড়িত ছিলাম। ওস্তাদের নিকট গান শিখি। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান করতাম। ভাল গান গাইতে পারতাম। একবার আমার এক গানের উস্তাদ অসুস্থ হলেন, উনাকে বিশেষ যত্ন নিয়ে সুস্থ করে তুলি। তারপর উনি আমাকে ও অনেক যত্ন করে গান শেখান। উস্তাদ গুল মোহাম্মদ সহ আরো অনেকের সান্নিধ্যেই গানের সব মাধ্যমেই পরদির্শতা অর্জন করি।

জুয়েল সাদত -মুক্তিযুদ্বে জড়ানো কিভাবে,আর কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেইনার হলেন?

ডাঃ শিশির – যখন লাহোরে ছিলাম, ২৫ মার্চের পরে একদিন হোস্টেলে আমাকে আটক করে বলতে থাকে পাকিস্থান নট ফর বাংলাদেশী বাস্টার্ড। সেদিন নেপালী ছাত্ররা আমাকে মুক্ত করে। তখন তারা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। তখন প্রিন্সিপাল আমাকে বলেন ন্যাশনাল ক্রাইসিস চলছ, তোমাদের হোষ্টেলে থাকা নিরাপদ নয়। তখন অনেকেই হোষ্টেল থেকে চলে গিয়েছিল। আমি যেহেতু গভর্নর স্কালারশিপে ছিলাম, তখন তারা আমাদের আর্মির সহায়তায় দেশে ফেরত পাঠাতে চাইছিল। তখন আমরা দুই তিন জন ছিলাম। এয়ারপোর্টে আমাদের হত্যা করতে পারে তাই অনেকেই আসেনি। আমি একা ঢাকা আসলাম ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। পায়ে হেঁটে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চলে আসি, তিনদিন পর চলে যাই নাটোরের গুরিদাসপুর গ্রামের বাড়ী। মা বলেন, পাশের গ্রামের ১৮ জনকে পাক আর্মি মেরে ফেলছে। তখন আমরা বাড়ীতে থাকতাম না মাঠে ঘুমাতাম । তখন কাউকে রাজি করাতে পারছিলাম না মুক্তিযুদ্বে যেতে। মাত্র তিনজন আমরা চলে যাই বাঙ্গালীপুর ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হিসাবে পরবর্তিতে পরিচিত আব্দুল জলিল ভাই, তিনি আমার আব্বার পরিচিত সেই হিসাবে আমাকে সুযোগ দিলেন । আমার পূর্বের মিলিটারী ট্রেনিং ছিল,সেই সাথে স্কাউটিং সহ নানা রকম ট্রেনিং থাকায় তিনি আমাকে ট্রেইনার হিসাবে কাজে লাগান। তিন মাস ট্রেনিং করাই । আমরা বেশীর ভাগ সময় রাতে অপারেশন করতাম, দিনে ট্রেনিং করাতাম ও ঘুমাতাম।

জুয়েল সাদাত ঃ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কিভাবে জড়ালেন?

ডাক্তার শিশির – আমাদের ক্যাস্পের নিকট ১০ জন মুক্তিযোদ্বা চাইল এক সময়। তখন আমাদেরর দশ জনকে সিলেক্ট করে। তখন আমাদের বলা হল তোমাদের বিশেষ ট্রেনিং এর নেয়া হচ্ছে, কই যাচ্ছ? কেন যাচ্ছ ? প্রশ্ন করতে পারবে না তখন আমাদের ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রাকে করে উচ্চতর ট্রেনিং এর জন্য্ জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে গেল। সেখানে আমরা তৃতীয় ব্যাচ হিসাবে ট্রেনিং এ যোগ দেই। সেখানে সিরাজুল ইসলাম খান, তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক ভাইদের সাথে দেখা হয়। তখন তারা বললেন তুমাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য্ প্লেনে নেয়া হবে, অনেক কষ্টের যারা কস্ট সহ্য করতে পারবে না, তারা যাবার দরকার নাই। আমরা দশজনই যেতে রাজি হই। আমাদের আর্মির পোশাক দেয়া হয়।

ইনু ভাইরা দ্বিতীয় ব্যাচে ট্রেনিং নেন, আমরা তৃতীয় ব্যাচে ট্রেনিং শেষ করি। তারা বললেন, সেটা একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্টনমেন্ট, তাই সবার মুসলিম নাম থাকা ঠিক হবে না। তখন সেখানে আমাদের প্রত্যেককে একটি হিন্দু নাম ধারন করতে হয়৷ আমার নাম দেয়া শিশির ভাদুড়ি ৷

পরবর্তিতে আমার জীবনে শিশির নামটা রেখে দেই স্মৃতি হিসাবে৷ গেরিলা ট্রেনিং এ নানা পরীক্ষা হত ৷ আমি ভাল ইংরেজী জানতাম, আমি কর্নেল মালহাতরার ইংরেজী স্পীচ ও নানা কৌশল ট্রেনিং শিট বাংলায ট্রান্সলেট করতাম, তাই সেখানে ও আমাকে স্কোয়াড লিডার বানানো হয়। কর্নেল মালাহাতরা আমাকে ট্রেইনার হিসাবে রেখে দেন। তখন আমার মহযোদ্বারা কর্নেল মালাহতরাকে অনুরোধ করেন, আমাকে নিয়ে দেশে যেতে। কারন সিরাজুল ইসলাম ( শিশির) দেশে না গেলে উনার মা চিন্তা করবেন তিনি মারা গেছেন, আর তাকে ছাড়া আমরা কিভাবে যুদ্ব করব। কি মনে করে কর্নেল মালাহাতরা আমাকে দেশে পাঠান৷

গেরিলা যুদ্বারা অনেক কৌশলী, তাদের মাধ্যমেই বড়ো বড়ো অপারেশন হত। গেরিলা যুদ্ধের কৌশলেই অনেক বড় বড় সফল অপারেশন হয়েছিল।

জুয়েল সাদাত – আপনি রাজাকারদের কিভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন? বুলেট নিয়ে নাকি আপনারা শপথ নিয়েছিলেন?

ডাঃ শিশির – আমি গেরিলাযোদ্বা ছিলাম। রাজাকার দের কাছে অনেক অস্ত্র আছে, গুলি ছিল। আমি তাদের নানা ভাবে কৌশলে আত্বসমর্পন করাই। তারা আমাদের কাছে যে কোন কারনে বা ভয়ে হউক বা জীবনের মায়ায় হউক একত্রিত হয়। তখন কোরআন শরিফের উপর আমার হাত, তারপর তাদের হাত তারপর বুলেট রেখে শপথ নেয়াতাম শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ মেনে চলব, দেশের সাথে বেইমানি করব না। যদি করি তাহলে এই বুলেটেই যেন জীবন যায়।

জুয়েল সাদাত – আপনারা কোন জায়গায় যুদ্ধ করেছেন?

ডাঃ শিশির – আমরা মুলত আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর যুদ্ধ করি। আত্রাই – গুরুদাসপুর- সিংরাই পুরো এলাকাতে আমরা নানা স্কুলে স্কুলে গিয়ে আমরা দশ জনই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেই, শেষ পর্যন্ত যার সংখ্যা দাড়ায় ১৪০০ জন। তারপর আমাদের এই বাহিনী এমন আক্রমন করে পাকিস্থানী বাহিনী পালানোর সুযোগ পায়নি। আমাদের এই সময়টাই মুক্তিযুদ্ধের অনেক সফলতা আসে। আমাদের নানা কৌশলের কারনে পাক বাহিনী দুর্বল হয়ে যায়।

জুয়েল সাদাত – আপনাদের মানে গেরিলা যুদ্বাদের লজিষ্টিক সাপোর্ট কেমন ছিল।

ডাঃ শিশির – আসলে অস্ত্র যুদ্ধ করে না, অস্ত্রের পেছনের মানুষ যুদ্ধ করে, আবার পেছনের মানুষ যুদ্ব করে না। একটা আদর্শকে সামনে রেখে যুদ্ধ হয়ে থাকে। একজন গেরিলা যুদ্বা ১০০ জন কনভেশনাল আর্মির সমান। গেরিলা যুদ্ধ হল কৌশল। আমরা রাতে ডানে বামে গুলাগুলি করতাম, তাদের ঘুমাতে দিতাম না। রাতের পর রাত পাকিস্থানি বাহিনী ঘুমাতে না পেরে কাহিল হয়ে পড়ত। তখন তাদের আক্রমন করলে সহজে জয়লাভ সম্ভব হত। তারপর নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে থানার ওসিকে কাবু করে থানার গোলাবারুদ আয়ত্ব করতে হত। গেরিলা যুদ্বটাই কৌশলের নানা মাধ্যমের প্রয়োগ।

জুয়েল সাদত ঃ যুদ্বকালীন সময়ে কি মনে হয়েছিল যুদ্ধ জয়লাভ সম্ভব?

ডাঃ শিশির – গেরিলা যুদ্ধ করতে প্রচুর পড়াশুনা করতে হত। আমি অনেক পড়াশুনা করেছি। যুদ্ধের ইতিহাস পড়তে হয়। আমাদের ভাষা,কৃস্টি, মানুষের দেশপ্রেম আমাদের যুদ্ধ জয়ের উ্যসাহ যোাগাত। আমাদের দাবিয়ে রাখা যাবে না এই বিশ্বাস ছিল। বন্ধু প্রতিম দেশ ভারত আমাদের শেষের দিকে সহযোগীতা করেছে। তাই যুদ্ধটা দ্রুত শেষ হয়েছে। তবে তাদের সহযোগীতানদ ছাড়াও আমরা যুদ্ধ জয় করতে পারতাম, একটু সময় লাগত। আর পাকিস্থান বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্বসমর্পন করেছিল তাদের সৈন্যদের নিরাপত্তার জন্য। সেখানেও রাজনীতি থাকতে পারে। তবে আমি বা আমরা জয়ি হব এই আত্ববিশ্বাস কাজ করত।

জুয়েল সাদত – মুক্তিযুদ্ধা, ভুয়া মুক্তিযোদ্বা ও রাজাকার সম্পর্কে কিছু বলেন ।

ডাঃ শিশির ঃ আমি আমার থানার ৩৯ নং মুক্তিযোদ্ধা। পুর্বের ৩৮ জন কোথায় যুদ্ধ করেছেন জানা নাই। সঠিক মুক্তিযুদ্বার তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নানা রাজনৈতিক কারনে হয়নি। তবে তা করা সম্ভব। অনেকেই যুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। যা দুঃখ জনক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্বারা কিছু পাবার জন্য যুদ্ধ করেন নি।

আমরা রাজাকার আল বদরদের বুঝিয়েছি, বলেছি এই নাও স্টেনগান পাকিস্থানীদেন হাতে মারা যাব কেন? তুমরা আমাদের মার। জনে জনে বুঝিয়ে তাদেরকে নিয়েই আমাদের যুদ্বের জন্য এগুতে হয়েছে। দেশের ভেতরের শত্রুরাই আমাদের জন্য্ ঝুকিপুর্ন ছিল। তাই তাদের জন্য বেশী সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এবং পুরো মুক্তিযুদ্বে সবচেয়ে বেশী ডেমেজ তাদের মাধ্যমেই হয়েছে।

জুয়েল সাদাত – যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে আপনার কি ভূমিকা ছিল?

ডাঃ শিশির – দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের লিডার সম্ভোধন করা হত। আমাদের সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হল দেশ পুনর্গঠনে। আমরা রাজাকারদের আলবদরদের কাজে লাগালাম। বললাম যদি কারও ঘরে লুটের মাল পাওয়া যাবে তার জন্য্ কঠিন শাস্তি। হিন্দু দের বাড়ি ঘর পুননির্মান করে দেয়া হল দু’সপ্তাহের মধ্য। অনেকেই ফিরে এসে টিনের ঘর পেয়ে গেল। যাদের টিনের ঘর ছিল না অতিতে। তখন বড়লোকদের নিকট থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নিয়ে এই কাজটা আমরা করে দেই। তখন গমের সিড দেই, অনেকেই কৃষিতে মনোনিবেশ করেন। আমাদের এলাকাটাকে পুনর্গঠন করি। আমি বলেছিলাম আমার ছেলেদের রাজাকারদের পিটাইতে পারবে, জানে মারা যাবে না। তাদের দেশ পুনর্গঠনে কাজে লাগাই। তারপর আমি ঢাকা মেডিকেলে পড়তে চলে যাই। সেখানে তখন অবাধে নকল হত। আমি স্যারদের বলি, আমরা মেধাবী ছাত্র আমাদের সহপাটিরা কেন নকল করবে। তারপর নকল বন্ধ হয়ে। সেখানে গুরত্বপুর্ন ভুমিকা রাখি। তারপর আমি বিপুল ভোটে জেনারেল সেক্রটারী নির্বাচিত হই। অভিষেকের টাকা বাঁচিয়ে ২০০০ গাছ লাগাই। যা আজও কালের সাক্ষী। দেশ গঠনে গ্রামে ও ঢাকায় জড়িত ছিলাম নানা ভা্বে।

জুয়েল সাদত – যুদ্ব পরবর্তি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের তিন বছর কেমন ছিল।

ডাঃ শিশির – আমাদের দেশের যুদ্ধ পরবর্তি সময়টানতে কিছু টানার্পোড়ন ছিল। সর্বহারা পার্টি ও সিরাজ সিকদার এর অন্য মোটিভ ছিল। আবার জাতির জনকের ক্লীয়ার কনসেপ্ট ছিল কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটানো যায়। বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ়তায় একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশকে গড়ে তুলেছেন। আমেরিকা আমাদের কোন সময় সহযোগিতা করেনি, উল্টো বটমলেস বাস্কেট বলেছিল। আজ সেই বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম উদাহরন সৃষ্টি করেছে। জাতির জনক তার দৃঢ়তায় দেশকে গড়ে তুলেছিলেন। যদিও তিনি তা শেষ করে যেতে পারেন নি। অনেকেই ভেবেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী যাবে না। অনেক মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছিল উনার শাসনামলে। তবে তিনি দেশকে অনেক কম সময়ে গড়ে তুলেছিলেন। কম সময়ে সংবিধান রচনা, নিবার্চন দেয়া, রাস্তা ঘাট ব্রীজ কালভার্ট সবাই কিছুই করতে পেরেছিলেন নিজের দৃঢ় চেতনা নিয়ে।

জুয়েল সাদাত – যুদ্ধ পরবর্তি কালে দেশ গঠনে সাধারন মানুষদের কি ভুমিকা ছিল।

ডাঃ শিশির ঃ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করায় বাংলাদেশ এক বিরাট শুন্যতার সৃস্টি হয়। তারপর যারা ছিলেন, তারা নিজেদের মেধা মনন কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা দাড় করান। সাধারন মানুষ দেশ গঠনে সক্রিয় ভুমিকা রাখে। মুক্তিযোদ্বার্ অস্ত্র আত্বসমর্পন করে দেশের নানা কাজে মনোনিবেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাধীন দেশটাকে সকলে গড়ে তুলেন।

জুয়েল সাদাত – আপনার সাথে যুদ্বের প্রানবন্ত গল্প শুনে মনে হচ্ছে এ রকম কখনও শুনিনি আগে। আপনার উচিত বই লেখা। সাধারন যুদ্বের গল্প , গেরিলা যুদ্ধের গল্প, নানা ট্রেনিং এর গল্প। আপনার অনেক বেশী বেশী লেখা উচিত।

ডাঃ শিশির – জি। আমার হাতে এখন অনেক সময়। আমি লিখব৷ সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনু বেচেঁ আছেন। আমার লেখা গুলোর ঘটনার তারা জীবন্ত উদাহরন। আমি ক্যাস্পে গান গাইতাম তারা শুনেছেন। একবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে তাদের সাথে দেখা তখন সেই ক্যাস্পের গল্পের কথা উঠে আসে। তারা আমার লম্বা দাড়ি দেখে চিনতে পারেন নি। আমি শিঘ্রই লিখতে শুরু করব।

জুয়েল সাদাত – আপনি কবে আমেরিকা আসেন। ধর্মিয় ব্যাপারে আপনার সিরিয়াসনেস কবে থেকে।

ডাঃ শিশির – আমি ৭৭ সালে আমেরিকা আসি। আমার মা নামাজ কালামের ব্যাপারে খুব আপোষহীন ছিলেন। নামাজ না পড়লে ভাত দিতেন না। আমি আমেরিকায় এসে ব্যাপক পড়াশুনা করে তাবলিগে জড়িয়ে যাই৷ আমি চারমাস না পুরো সাত মাস তাবলিগে এক নাগাড়ে ছিলাম। আমি অনেক দিন হসপিটালে ও প্রাকটিসের বাহিরে ছিলাম। যখন আমার হসপিটালের চাকরী চলে যাবার নোটিশ আসে তখন আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে।

জুয়েল সাদাত – আপনাকে দেখা গেছে ভাল গান গাইতে পারেন, আবার একজন গেরিলা যুদ্বা। আবার আপনাকে দেখা গেল তাবলিগ জামাতে জড়িত।

একটু বলবেন? অনেক গুলো মসজিদ তৈরী করেছেন।

ডাঃ শিশির – আমি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাশ করে ডাক্তারী পেশায় মনোনিবেশ করি । তারপর ১৯৭৭ সালে আমেরিকায় আসি। তখন এখনকার মত বিদেশে আসা সহজ ছিল না। সরকারি ক্লীয়ারেন্স পাওয়া যেত না। তারপর ৮৭ সালে অরলান্ডো ( ফ্লোরিডা) আমেরিকা আসি। যেখানে আমার জীবনের বেশীর ভাগ সময় কাটালাম। গ্যাস্ট্রোলজির উপর ডিগ্রি নেই। সাথে সাথে দাওয়াতে যোগ দেই। তাবলিগ জামাতে যোগ দেই জীবনের পরিবর্তন আসে। তারপর গান টান আর গাওয়া হয় না। তারপর ওরলান্ডোতে দাওয়াতের নানা মাধ্যমে জড়াই। তারপর অনেক মসজিদ মাদ্রাসা তৈরী করি। দাওয়াতের জন্য্ সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াই। আলহামদুলিল্লাহ আজ গ্রেটার ওরলান্ডোতে ছোট বড় ৩৮ টি মসজিদ। একটা মজার ঘটনা বলি, ওরলান্ডো জামে মসজিদ যেটা ডিজনি এরিয়াতে, সেটা আমার যখন মাত্র ৫০ জন্য মুসল্লি ছিলাম এই শহরে তখন ১ লাখ ডলারে জায়গা কিনে সর্বমোট ৬ লাখ ডলারে তৈরী করি। তখন ৬০০ জনে নামাজ পড়ার জন্য্ বানাই। তখন অনেকে আমাকে বলে এত নামাজি হবে না। আপনি জানেন এখন সেই মসজিদটাই আমরা ৫ হাজার মুসল্লির জন্য্ বানাচ্ছি। আমি চেষ্টা করি সব কিছুতে সম্পৃক্ত থাকতে। এভাবেই জড়িয়ে যাই।

জুয়েল সাদাত – শুনেছি আপনি আপনার গ্রামের বাড়িতে অনেক বড় কারিগরি মাদ্রাসা করেছেন।

ডাঃ শিশির – আসলে আমার বড় ভাই যিনি আজ আমাদের মাঝে নাই। উনি শুরু করেছিলেন। পরবর্তিতে আমরা সব ভাই বোন এটাকে বড়ো করেছি। আমি এটার সাথে বেশী সম্পৃক্ত। অনেক বৃহদ এলাকা নিয়ে মাদ্রাসা। যা রাজশাহী বিভাগের একটি আইডল প্রতিষ্ঠান। সেখানে হাফিজ দের কারিগরি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে৷ বর্তমানে ৪০ জন শিক্ষকদের জন্য্ এপার্টমেন্ট বানিয়ে দিচ্ছি। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মাদ্রাসায় থাকবেন, ছাত্রদের পড়াশুনাটাও ভাল হবে। যা বাংলাদেশে প্রথম। শিক্ষক রা ফ্রি থাকার বাসস্থান পাচ্ছেন। পুরো প্রজেক্ট টি বিশাল এলাকা জুড়ে। এখানে আমি একটি আন্তর্জাতিক মানের লাইব্রেরী করব, যা হবে রাজমাশী বিভাগের অন্যতম। অনেক বই কেনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হাজার হাজার কোরআনে হাফেজ বের হবেন, উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে। বর্তমানেও হাফেজ বের হচ্ছেন। পুরো কমপ্লেক্সটা বিরাট এলাকা জুড়ে।

জুয়েল সাদত – আপনি হোপ ফাউন্ডেশনের সাথে জড়িত, কি কি কাজে আপনারা জড়িত।

ডাঃ শিশির – আমার একজন প্রিয় মানুষ , ডাক্তার ইফতেখার মাহমুদ হোপ ফাউন্ডেশন তৈরী করেন ৯৮ সালে। আমি এটার বোর্ড অব ডায়রেক্টর। কক্সবাজার ও রামুতে আমাদের ৪০ বেডের হসপিটাল আছে। আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছি। ডাক্তার ইফতেখার আমাকে বড় আকারে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। হোপ ফাউন্ডেশেনর সাথে ১৬০০ ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মিরা জড়িত। সেটা অনেক বড় আকারে কাজে করছে বর্তমানে কক্সবাজার, রামু সহ অনেক জায়গায়।

জুয়েল সাদত – আপনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত চিক্যিসক। একটু যদি বলেন।

ডাঃ শিশির ঃ শেখ কামালের সহপাটি হিসাবে সম্পর্কটা অনেক কাছের। যখনই তিনি আমেরিকায় আসতেন আমার তত্বাবধানেই উনার চিকিৎসা্ হত। একবার উনার গল্ডব্লাডার অপারেশন হল, উনার ইচ্ছানুযায়ী আমি অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। সারা রাত পাশেই ছিলাম। শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনাকে জানান আমি বাড়ি যাইনি সারা রাত পাশে ছিলাম ৷ আমি ছিলাম সেই সময়টাতে। ভাইয়ের মত সম্বোধন করেন। আমি গ্যাস্ট্রলজির ডাক্তার একবার আপাকে বললাম, বাংলাদেশে গ্যাস্ট্রেলজির একটি বিশেষ হসপিটাল করতে পারলে ভাল হত। তখন তিনি বলেছিলেন যদি সরকারে যাই তখন করব৷ তারপর ২০০৮ সালে তিনি সেটার কাজ শুরু করেন। । আমি এর শুরু থেকে জড়িত ছিলাম ৷ উদ্ভোধনি অনুষ্টানে আমাকে থাকতে হয়েছিল। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, এই হসপিটালটা ভাল চলছে। বৃটিশ একটি টিম সম্প্রতি ভিজিট করে এটাকে লন্ডনের চাইতেও ভাল বলে রিপোর্ট করেছেন।

আমি যেহেতু দীর্ঘদিন থেকে উনার শারীরিক সুস্থতা অসুস্থতা নিয়ে নিবেদিত। তাই তিনি আমার পরামর্শকে গুরুত্ব দেন। সেভাবেই আমার পরামর্শে আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভাল আছেন। আপনারা জেনে খুশি হবেন উনার বড়ো কোন শারিরীক অসুবিধা না।

জুয়েল সাদত – একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশের বর্তমান উন্নতিকে কিভাবে দেখেন। মুক্তিযোদ্বাদের ভাতা বেড়েছে কেমন বোধ করেন?

ডাঃ শিশির – স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তিতে দেশের আশাতিত উন্নতিতে মনে হয়ে স্বাধীনতার সুফল আমরা পেয়ে গেছি। যা দেখে আমি নিজে গর্বিত। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নিকট রোল মডেল। মুক্তিযোদ্বাদের ভাতা বেড়েছে, আজ মুত্তিযোদ্বারা নিজেকে অসহায় বোধ করেন না। তারা গৃহঋন পাচ্ছেন। নানা রকম পন্থায় মুক্তিযোদ্বাদের মুল্যায়ন করা হচ্ছে, সেটা দেখে আনন্দিত হচ্ছি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।

জুয়েল সাদাত – আপনার নিকট বাংলাদেশের এই মুহুর্তে বড়ো সমস্যা কি?

ডাঃ শিশির- আমাদের দেশের ডেভেলপমেন্ট দেখে বিশ্বের অনেক দেখ স্তম্বিত। জাতীসংঘ বাংলাদেশের উন্নতিকে রুল মডেল হিসাবে দেখাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক- জাতিসংঘ এর কাছে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার নাম। তবে এখন নতুন প্রজন্মদের দুর্নীতির বিরদ্বে জেহাদ ঘোষনা করতে হবে। যদি দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা যায় তাহলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। দুর্নিতী বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে, সেটাকে জিরো টলারেন্স নিয়ে আনতে হবে। তবে সম্ভাবনার বাংলাদেশ। আমাদের দেশটা আসলেই সোনায় মাড়ানো। সোনার বাংলায সোনা ফলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের একটি পজেটিভ রোল মডেল।

জুয়েল সাদত – আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

ডাঃ শিশির – আমি এই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশে যাব। স্থায়ী ভাবে বসবাস করার ইচ্ছা। সেখানে অনেক কাজ, অনেক বড় বড়ো প্রজেক্ট অসমাপ্ত সেগুলো তে মনোনিবেশ করব। তবে বছরের বেশীর সময় দেশেই কাটাবোদেশের মাটিতে শেষ জীবন কাটাতে চাই। একটি গান আছে ” তোরা দে না, দেনা, সেই মাটি আমর অঙ্গে ” আমি সেই মাটিতেই ফিরে যেতে চাই। আমি আমার পিতা মাতার কবরের পাশেই থাকব।আমর জন্য্ দোয়া করবেন। যদি নিজের অজান্তে কোন ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে তার জন্য্ ক্ষমা চাচ্ছি।

জুয়েল সাদাত ঃ আপনাকে ধন্যবাদ।

ডাঃ শিশির ঃ আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।

লেখকঃ জুয়েল সাদাত, সাংবাদিক কলামিষ্ট আমেরিকা, ফ্লোরিডা

You might also like