তাজমহল তোমার দিন গিয়াছে

 দিলীপ মজুমদার

 

বিশ্বের বিস্ময় তাজমহল । কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল । এ দেশের প্রেম কাহিনির জনক শা্হজাহানের প্রেমের নিদর্শন তাজমহল । এক উর্দু কবি আপশোশ করে লিখেছেন,

এক শাহনশাহ-নে দৌলত-কা সাহারা লেকর
হাম গরিবো-কী মুহব্বৎ কা উড়ায়া মজা

কথাটা বেঠিক নয় । গরিব মানুষের এত টাকা-পয়সা কোথায় যে সে তার প্রেমিকাকে অমর করে রাখবার জন্য এমন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবে যা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে অন্য মানুষ ! কিন্তু অন্য দিকটাও ভেবে দেখতে হবে । পয়সা থাকলেই কি এমন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যায় ? তা যদি যেত তাহলে আমাদের এই বসুন্ধরায় পরমাশ্চর্যময় স্মৃতিসৌধের সংখ্যা হত অগণন । সম্রাট শা্হজাহানের অর্থ ছিল , সেই সঙ্গে ছিল প্রগাঢ় প্রেম। ছিল প্রেমের শক্তি ।সে প্রেমের শুরু ১৬০৭ সালে । মিনাবাজারের কাছে রাজকুমার খুররম একটা কাচের দোকানে দেখলেন আর্জুমান্দ বেগম বানুকে । কথাও বললেন দু’একটা । চোখের দেখা মরমে পশিল গো । কোন আলো লাগল চোখে । পিতা জাহাঙ্গীরকে অকপটে বললেন সে কথা । কিন্তু তারপরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় চাপা পড়ল সে কথা । বিয়েও করতে হল শা্হজাহানকে । কিন্তু তিনি ভুলতে পারেন নি আর্জুমান্দ বেগম বানুকে । পাঁচ বছর পরে বিয়ে করলেন তাঁকে । শা্হজাহানের প্রিয়তমা মমতাজ বেগম । খুব বেশিদিন দাম্পত্য সুখ ভোগ করতে পারেন নি মমতাজ । ১৬৩১ সালে মৃত্যু হয় তাঁর । মৃত্যুর পরে মমতাজের সমাধি তৈরি করার অঙ্গীকার করেছিলেন শা্হজাহান ।

মমতাজের মৃত্যুর পরের বছর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাজমহল নির্মাণের কাজ । পরবর্তীকালের ইংরেজ শাসকরা এই অপূর্ব স্থাপত্যের শিল্পী হিসেবে নিজেদের জাহির করতে চেয়েছেন । ইতিহাস তা স্বীকার করে নি । এই সৌধের প্রধান স্থপতি ছিলেন ইরানের ওস্তাদ ঈশা আর তার মূল ভিত্তি রচনা করেন তুর্কির ইসমাইল আফান্দি । বাগদাদ , সিরাজ , বুখারা , কনৌজ , দিল্লি , লাহোর থেকে আসেন সেরা কারিগরেরা । পঞ্জাব , বাগদাদ , শ্রীলঙ্কা , তিব্বত , আরব , চিন , ইউরোপ থেকে আসে নানা মূল্যবান রত্ন । ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছরের কঠোর পরিশ্রমে ৩ কোটি ২০ লক্ষ অর্থ ব্যয়ে গড়ে ওঠে তাজমহল । বন্দি শা্হজাহান না কি আগ্রা দুর্গের একটা ছোট ফোটো দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে ।কিন্তু সেই তাজমহলের দিন গিয়াছে । এবার তাহার ঝুঁটি ধরিয়া টানাটানি শুরু হইয়াছে ।এই টানাটানির শুরু ২০১৫ সালে । আগ্রা দায়রা জজ আদালতে অগ্রেশ্বর মহাদেব নাগনাথেশ্বর বিরাজমানের হয়ে মামলা করেন শংকর জৈন । এক দল আইনজীবী দাখিল করেন ৭টি পিটিশন । তাঁদের দাবি এখানে ছিল তেজো মহালয়া নামে এক শিব মন্দির । আদালতের কাছে তাঁরা আবেদন করেন ১, তাজমহলের ভিতর হিন্দুদের পুজাপাঠের অনুমতি দিতে হবে ২, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বের অনুসন্ধান চালাবে । কেননা তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস অন্তত ১০৯ টি প্রত্নতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে যাতে প্রমাণিত হয় যে এখানে আগে হিন্দু মন্দির ছিল। আগ্রা দায়রা জজ আদালত আবেদনকারীদের খুব বেশি প্রশ্রয় দেন নি । কিন্তু তাঁরা দমেও যান নি।

সম্প্রতি এলাহবাদ হাইকোর্টে এক মামলা করেছেন বিজেপির মিডিয়া-ইন-চার্জ ড. রজনীশ সিং । এই মামলাতেও ধ্বনিত হচ্ছে তেজো মহালয়ার কথা। শুধু তাই নয়, কথা উঠেছে তাজমহলের তালাবন্ধ ২০টি ঘরের । মামলাকারীর দাবি তালা ভাঙলেই উন্মুক্ত হবে প্যান্ডোরার বাক্স । বেরিয়ে পড়বে ইন্দু দেব-দেবীর মূর্তি । পাওয়া যাবে হিন্দুধর্মের নানা নিদর্শন। এমনই দাবি করে বই লিখেছেন পুরুষোত্তম নাগেশ ওক ( Taj Mahal : Tht True Story ) । তিনি বলেন তাজমহলের অক্টাগোনাল স্ট্রাকচার মুসলমান রীতির নজির নয় , একান্তভাবে হিন্দুরীতির । তিনি আবার আর এক কাঠি উপরে চলেন । তিনি মনে করেন ইসলাম ধর্ম , খ্রিস্টধর্ম সবই হিন্দু ধর্ম থেকে জাত । কৃষ্ণনীতি থেকে এসেছে ক্রিশ্চানিটি ।
নতুন ইতিহাস রচনার কঠিন শপথ নিয়েছে ভারতীয় জনতা দল । মুসলানদের ছেড়ে কবে তাঁরা ইংরেজদের ধরবে তাই ভাবি।তখন হয়তো মনুমেন্টের বা ভিক্টোরিয়ার তলায় পাওয়া যাবে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব।সেই যে উদ্দীপ্ত করসেবকরা চেঁচিয়ে ছিলেন ‘অযোধ্যা তো স্রিফ ঝাঁকি হ্যায় / কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’ – সেটাই কালে কালে সত্য হয়ে উঠবে।সেই যে আইন হয়েছিল ১৯৯১ সালের আগে তৈরি কোন সৌধকে ভাঙা চলবে না,তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কতক্ষণ !তাই বলছিলাম : তাজমহল তোমার দিন গিয়াছে ।

লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

You might also like