নাটক বলে নাটক 

 দিলীপ মজুমদার

পশ্চিমবঙ্গে শোচনীয় পরাজয়টা ভারতীয় জনতা দল মেনে নিতে পারেন নি।নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকচক্ষু থেকে  দূরে সরে গেলেন।তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেউ কেউ থানায় জানাল।আসলে লজ্জার ব্যাপার একটা ছিল।পশ্চিমবঙ্গের লড়াইটায় জয় তাঁদের দরকার ছিল।সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন  তাঁরা।এমন কী নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কার্যক্রম পরোক্ষে তাঁদের সাহায্য করেছে ।তারপরে আছেন রাজ্যপাল।তাঁকে তো বিরোধীরা বিজেপির এজেন্ট বলে কটাক্ষ করেছেন।প্রতিটি ফেজের নির্বাচনে কত আসন পাবেন, তা আগাম বলে দিচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।কিন্তু হিসেব মিলল না।বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূল দল জয়লাভ করল ।

এই পরাজয়ের দায় কার ? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলার নেতাদের দিকে আঙুল তুললেন । কিন্তু প্রার্থীনির্বাচন থেকে যাবতীয় কাজ বাইরের নেতারাই করেছেন।সংঘ পরিবার হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। তাঁরা এই পরাজয়ের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দায়ী করলেন।বিশ্বের মানুষ তাকিয়েছিলেন এই নির্বাচনের দিকে।নানাদেশের পত্র-পত্রিকায় মোদির সমালোচনা প্রকাশিত হল।করোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে নাজেহাল মোদি সরকার।মোদি জানু্য়ারি মাসেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে তাঁরা করোনাযুদ্ধে জয়ী।বিশ্বগুরু হাবার বাসনায় মোদি ভারতের টিকা বিদেশে বিলিয়ে দিয়েছেন।তারপরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন ভারতকে প্লাবিত করল তখন দেখা গেল টিকা নেই, অক্সিজেন নেই, পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, মৃতদেহ সৎকার করার ব্যবস্থাও নেই । মৃতদেহ সৎকার না করে বিজেপি রাজ্যে সেসব দেহ হয় মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে, নতুবা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে । বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তি তলানিতে নেমে গেল ।

এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে শোচনীয় পরাজয় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা । তাঁরা নতুন নাটকের চিত্রনাট্য রচনা করতে লাগলেন । নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরের দিন থেকে তাঁদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ শুরু করে দিলেন ।রাজ্যপালও সেই বক্তব্য তাঁর বিখ্যাত টুইটগুলিতে তুলে ধরতে লাগলেন। আইন-শৃঙ্কলার বিপর্যয়ের অজুহাতে রাষ্ট্রপতি শাসন যাতে করা যায় ।এবার তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করলেন সিবিআই ।১৭ মে বিশাল বাহিনী নিয়ে  সিবিআই গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলেন তৃণমূলের দুজন মন্ত্রী,একজন বিধায়ক ও কলকাতার প্রাক্তন মে্য়র ও মন্ত্রীকে।এটা ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনের পরিণতি বলে সাফাই দিলেন সিবিআই।২০১৪ সালের ঘটনা । সিবিআই তদন্তের ভার নিয়েছিলেন  ২০১৭ সালে । যাঁদের গ্রেপ্তার করা হল, তাঁরা পালিয়ে যান নি,যখন সিবিআই ডেকেছেন তাঁরা উপস্থিত হয়েছেন।তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও তৈরি ছিল।বিধানসভার স্পিকারের অনুমতি না নিয়ে, রাজ্যপালের অনুমতি নিয়ে এই গ্রেপ্তার ।কেউ কেউ রাজ্যপালের এক্তিয়ারের প্রশ্ন তুলেছেন ।

অভিযুক্তদের নিজাম প্যালেসে নিয়ে আসা হল । মুখ্যমন্ত্রী , আইনমন্ত্রী ছুটে এলেন । মুখ্যমন্ত্রী প্রায় ৬ ঘন্টা নিজাম প্যালেসে বসেছিলেন । তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা নিজাম প্যালেস ও রাজভবনের চারদিকে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে লাগলেন । এটাই সম্ভবত ছিল সিবিআইএর ফাঁদ।মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকরা সেই ফাঁদে পা দিলেন । সিবিআই স্বভাবতই বলতে লাগলেন ‘প্রভাবশালী’ তত্ত্বের কথা।নিম্ন আদালতে বিচার চলতে লাগল।সন্ধের দিকে জামিন দিলেন নিম্ন আদালত।কিন্তু সিবিআই অতি সক্রিয় । তাঁরা হাইকোর্টে আপিল করলেন । হাইকোর্ট জামিনের উপর স্থগিতাদেশ দিলেন। দুদিন পরে শুনানি।সেখানেও নাটক।দুই বিচারপতির দুই রকম মত।একজন জামিনের পক্ষে অন্যজন বিপক্ষে।ফলে তৃতীয় বেঞ্চ গঠন।এদিকে আবার চার অভিযুক্তের মধ্যে তিনজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।হাইকোর্ট জামিন নিয়ে সুস্পষ্ট রায় না দিলেও অভিযুক্তদের জেল হেফাজত থেকে আপনাপন গৃহে নজরবন্দি হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন । কিন্তু ফিরহাদ হাকিম ছাড়া আর কেউ বাড়ি ফিরতে পারেন নি । অসুস্থতার জন্য ।

লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

You might also like