না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা
দিলীপ মজুমদার
২০১৪সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেন । নিজেকে তিনি দেশের সম্পদের ‘চৌকিদার’ বলে উল্লেখ করেন সগর্বে।চৌকিদারের কাজ হল পাহারা দেওয়া,চুরি-ডাকাতি আটকানো।নরেন্দ্র মোদি বেশ জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন : ‘না খাউঙ্গা,না খানে দুঙ্গা’।অর্থাৎ আমি যেমন ঘুষ নেব না,তেমনি অন্যদেরও ঘুষ নিতে দেব না।এই ঘোষণা শুনে সাধারণ মানুষের বুকে বল এসেছিল।যাক বাবা,এতদিনে এক প্রধানমন্ত্রী এলেন যিনি কালোটাকা,কালোবাজারির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত।প্রথম থেকেই।তাঁর নোটবন্দিকেও স্বাগত জানাল মানুষ।কেননা নোটবন্দি করে তিনি কালোটাকা ধরতে চান।
২০১৪ থেকে ২০১৮।২০১৮তে সিএমএস একটি সমীক্ষা করল অন্ধ্র,কর্নাটক, তামিলনাড়ু,তেলেঙ্গানা,বিহার,মধ্যপ্রদেশ,উত্তরপ্রদেশ,পশ্চিমবঙ্গ,দিল্লি,পঞ্জাব,রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট এই তেরোটি রাজ্যকে নিয়ে।সমীক্ষায় দেখা গেল দেশের ৭৫% মানুষ মনে করেন মোদির রাজত্বে দুর্নীতি বেড়েছে।পরিবহন,পুলিশ,গৃহনির্মাণ,স্বাস্থ্য পরিষেবা– ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতির বহর বেশি।সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে নবনির্বাচিত রাজ্য সরকারের দুজন মন্ত্রী, একজন বিধায়ক ও কলকাতার প্রাক্তন মে্য়রকে সিবিআই নারদকাণ্ডে ঘুষ নেবার অভিযোগে গ্রেপ্তার করল।প্রায় ৭ বছর মামলা চলার পর কোভিদ সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এরকম গ্রেপ্তারকে অনেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে মনে করেন ।যে সময়ে ও যে ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাই প্রমাণ।আবার বিজেপির সমর্থকরা মনে করেন চৌকিদার প্রধানমন্ত্রী কীভাবে কড়া হাতে দুর্নীতি দমন করেন,এটা তার প্রমাণ ।
নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, না খাউঙ্গা । কিন্তু রাহুল গান্ধীর অভিযোগ ছিল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে মোদি সাহারা গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৪০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন । আবার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে ৩৬টি রাফাল বিমান কেনার ব্যাপারে ৪২ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির কথাও বলা হয় ।
নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, না খানে দুঙ্গা । তাই যদি হবে তবে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে যে নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিক্রম কোঠারিরা বিদেশে পালিয়ে গেলেন, তাদের ধরে আনার ব্যবস্থা করছেন না কেন মোদি ? কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বিএস ইয়েদুরাপ্পা জমি ও খনি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত । তাঁর ডায়ারিতে দেখা গেছে বিজেপি নেতা, বিচারক ও আ্যডভোকেটদের প্রচুর উৎকোচ দেওয়া হয়েছে । সিবিআই তদন্ত করেছে, কিন্তু ইয়েদুরাপ্পার টিকি ছুঁতে পারে নি।উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্তী থাকার সময়ে রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক জমি ও হাইড্রোইলেকট্রিক প্রকল্পের দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন । সিবিআই তদন্ত করেছে, কিন্তু তাঁর কিছুই করতে পারে নি। কর্নাটকের বেলেরির রেড্ডিভ্রাতৃদ্বয় যোল হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ।
মোদি সরকার তাঁকে শাস্তি না দিয়ে তাঁর বিষয়ে তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন যিনি সেই বনবিভাগের অফিসারকে বহিষ্কৃত করেছেন । হিমন্তবিশ্ব শর্মা যখন কংগ্রেসে ছিলেন তখন জলসরবরাহ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হন । তিনি বিজেপিতে যোগ দেবার পরে তদন্ত আর গতি পায় নি।ঠিক যেমন মুকুল রায় । নারদ কাণ্ডে তিনিও যুক্ত।কিন্তু তিনি এখন বিজেপিতে।তাই তিনি মুক্ত বিহঙ্গ । মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, মহারাষ্ট্রের মুর্খমন্ত্রী নারায়ণ রানেও আর্ধিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত।কিন্তু শাস্তি ভোগ করতে হয় নি তাঁদের।অজয় নিশাদ, অনুরাগ সিং ঠাকুর,অজয়কুমার,সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, নিশীথ প্রমাণিক,ব্রিজভূষণ সিং, দিলীপকুমার ঘোষ,ভোলা সিং, ভাণুপ্রতাপ সিং ভার্মা, অশোককুমার যাদব,জগদম্বিকা পাল,গণেশ সিং,গৌতম গম্ভীর,হরিশ দ্বিবেদী,জগন্নাথ সরকার,নিশিকান্ত দুবে.পঙ্কজ চৌধুরী,নরেন্দ্রকুমার,ওম বিরলা,কৌশল কিশোর,কমলেশ পাশোয়ান,জন বার্লা, লকেট চ্যাটার্জী,লাল্লু সিং,কেশরী দেবী পটেল,খান সুমিত্রা—এরকম ১১৬ জন বিজেপি সাংসদের নামে একাধিক ফৌজদারি মামলা আছে।অথচ দুর্নীতিদমনকারী নরেন্দ্র মোদির দল এঁদের প্রার্থী করেছেন।তাই পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিদমনের জন্য তৃণমূলের মন্ত্রী,বিধায়ক ও প্রাক্তন মেয়রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হলেও ব্যাপারটা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে।রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের ব্যাপারটাই সামনে আসে।
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।