পঙ্কজ ভট্টাচার্য, গণমানুষের প্রজ্জলিত মশাল
আদিত্য শাহীন
প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের জীবন্ত কীংবদন্তী, ঐক্যন্যাপ এর সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন অসুস্থ। বাঙালির রাজনৈতিক জীবনের এক আদর্শ প্রতিচ্ছবি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। নির্লোভ, ব্যক্তিস্বার্থের তাড়নাহীন এক মানুষ। একজন আদর্শ বাঙালির জীবন কতটা সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তা এক ঝলকে জানা যায় তার অবয়ব দেখে। মুখের কথা শুনে। গত শতকে বাঙালির জীবন সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত তিনি। মাস্টার দা সূর্য সেনের রাজনৈতিক আদর্শ এখনও তার চেতনার গভীরে। এখনও তার দিনরাত্রী গণমানুষের ভাবনায়।
দুই বছর আগে সহসংগ্রামী ও জীবনসঙ্গী রাখীদাশ পুরকায়স্থ প্রয়াত হয়েছেন। সেই শোকের সঙ্গে শারীরিক নানা জটিলতায় পঙ্কজ দা’র বিপুল কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা ছন্দপতন এসেছে। ৮০ বছর পেরিয়েছে বেশ আগে, সেটি নিছক সংখ্যায়। জীবনের গতি সবসময় থেকেছে একই রকম। শরীর বেঁকে বসতে চাইলেও মনের জোরের কাছে হেরেছে বার বার। টানা ছয়মাস হাসপাতাল-বাসা চলছে। এই ভালো, এই খারাপ। আমরা (আমি ও আমার স্ত্রী লাইলা খালেদা) পঙ্কজ দা’র জন্য বেশ উদ্বিগ্ন থাকি। শরীরের খোঁজ জানতে ব্যাকুল থাকি। শ্বাসযন্ত্রজনিত সংকটের কারণে তার সঙ্গে হুটহাট দেখা করা বারণ। ফোনে কথা বলা বারণ। করোনা কঠিন সময় পেরুনোর পর এখন মানুষের জীবন অন্যরকম হয়ে গেছে। অনেক কিছুতেই উদ্বেগ যেমন বেড়েছে, একইভাবে অনেক কিছুই সহ্য হয়ে গেছে মানুষের।
লাইলা খালেদা সরাসরি পঙ্কজ দা’র রাজনৈতিক কর্মী। গণফোরাম সময় থেকে বিভিন্ন দায়িত্বে মাঠে ময়দানে রাজপথে পঙ্কজ দা’র সঙ্গে। ঐক্যন্যাপ প্রতিষ্ঠিত হলে সে প্রথম কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। আমি সেই সুবাদে পঙ্কজ দা’র দারুণ সাহচর্য পেয়েছি। পঙ্কজ দা’র সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমারও একটি পৃথক জায়গা তৈরি হয়েছে গত দেড় দশকে। অনেক বিষয়েই বোঝার জন্য জানার জন্য পঙ্কজ দা’র কাছে ফোন করি। বাসাই যাই। বলা যায় আমাদের জীবনশিক্ষক তিনি। আমরা তার সন্তানের মতো। তিনি আমাদের পিতৃতুল্য। তিনি আমাদের মাথার ওপরের সবচেয়ে নিরাপদ ছায়া।
অনেকদিন আমরা আমেরিকায়। এসেই ভালো-মন্দে নিয়মিত কথা হয়েছে দাদার সঙ্গে। কিন্তু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কথা বন্ধ। এমনকি যোগাযোগও অনেকটা বন্ধ। অনেকের কাছে ফোন করে আংশিক খবর পাই। তার শরীরের নানা পরিস্থিতি আর চিকিৎসার খবর অজানাই থাকে। উদ্বিগ্ন থাকি। রোববার সকালে হঠাৎ পঙ্কজ দা’র ফোন থেকে একটি মেসেজ এলো। একটি ভিডিও মেসেজ। ভিডিওটি ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানের। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির ভিডিও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছেন পঙ্কজ দা। এই অনুষ্ঠানের আলোকচিত্রটি আমাদের ঘরেও ছিল। পঙ্কজ দা’র ছবিটি দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠল। মেসেজের জবাব লিখলাম—“ধন্যবাদ দাদা। এটি সংগ্রহে থাকা প্রয়োজন। আপনার হোয়াটস অ্যাপ থেকে এই বার্তাটি আসায় খুব খুশি হলাম। আশা করি আপনার শরীর এখন অনেকটা ভালো। সতত শুভকামনা।”
সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও কল। পঙ্কজ দা নিজে কথা বলছেন। তার নাকে সরু অক্সিজেন পাইপ লাগানো। সেই তেজদীপ্ত কথাবার্তা। পাল্টে গেল আমাদের দিন। অনেক কথা হলো। তার কিছুটা শেয়ার করতে চাই। “অবস্থার একটু উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন চলছে। আমি একটি অনুরোধ করব তোমাদের। জার্মানির একটি পোর্টেবল শ্বাসযন্ত্র আছে, কোনো ডাক্তার পরিচিত থাকলে জেনে, আমাকে বিস্তারিত জানাবে। তোমরা বাচ্চাদের নিয়ে সুখী থাকলে আমি অনেক আনন্দ পাব। তোমাদের কথা আমার খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে যখন আইসিইউতে অচেতন অবস্থায় কাটিয়েছি, অপারেশন টেবিলে যখন ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি, আমি হাসি-ঠাট্টা করেছি বটে, ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। যাতে হেরে না যাই, এখন ছয়মাস পরে কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। গতকাল প্রেসিডিয়াম মিটিং করেছি বাসায়।
তোমার (লাইলা খালেদা) কথা বলেছি। বলেছি তুমি থাকলে, তোমাকেও ডাকতাম। পত্রিকার কাটিংগুলো তোমাদের কাছে পাঠাতে পারি। তোমরা ভালো থেকো। লেখালেখি করো। রাখী (রাখীদাশ পুরকায়স্থ) তো চলে গেল। এখন বহ্নিশিখা, আমার শালিকা, ছয় বছর বয়স থেকে আমার কাছে, কন্যাতুল্য, সে তার স্বামী প্রফেসর ড. মানস বসু অষ্টপ্রহর আমার জন্য কাজ করে। এমনকি মৌসুমীও (আমার আরেক শালিকা) হাসপাতালে আমার জন্য অনেক করেছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান হাসপাতালে আমার অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থেকেছে। আমার সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে দেখা করতে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সরওয়ার আলী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফৌজিয়া মোসলেম নিয়মিত আমাকে দেখতে আসে।
অন্যান্য নেতারাও দেখতে আসেন। এখন বাসায় আছি। বেশি কথা বলা এখনও বারণ। আজ একটু সুযোগে তোমাদের খবর নিলাম। আর আমি কিছু বিবৃতি ও নিউজ তোমাদের কাছে পাঠাব হোয়াটস অ্যাপে। শোনো আমার পুত্র-কন্যার অভাব নেই। একটি কবিতা আছে রবীন্দ্রনাথের—
“পিতা কর নাই বলে করিয়াছ পিতামহ, হে বিধাতা”
আমার ডজন ডজন ছেলেমেয়ে আছে। জিন্দাপার্কের লোকজন একদিন বিশেষ প্রার্থনা করেছে আমার উদ্দেশে।
আমার রোগমুক্তির জন্য রোজা করেছে। আমি তো এই ভালোবাসাতেই সুস্থ হয়ে আছি। আমার একটি বই বের হবে ফেব্রুয়ারিতে। প্রকাশিত হলে কারো মাধ্যমে তোমাদের কাছে পৌঁছাব। আমি তো তোমাদের দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। তোমাদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করব। বাচ্চাদের কোলে নিব। আমি আরো কিছুদিন সচল থাকতে চাই। সক্রিয় থাকতে চাই। কিছু মানুষের উপকার করতে চাই। আমার নিজের কিছু দরকার নাই। তোমরা ভালো থাকলে আমি খুব খুশি হব। তোমরা ভালো থেকো। বাচ্চাদের ভালো রেখো।’
বাচ্চাদের শিক্ষাটা যেন ভালো হয়। বাংলাটা যাতে ভুলে না যায়, এইদিকে খেয়াল রেখো। বাংলা ভুলে গেলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যাবে। অনেক বাচ্চা দেখেছি, বাপ মা বাংলা সিলোটি, কিন্তু বাচ্চারা বাংলা ভাষা জানে না। রবীন্দ্রনাথের গান করছে, ইংরেজি ফোনেটিকে লিখে তা উচ্চারণ করছে। এইটা আমার কাছে খুব মর্মস্পর্শী। বাংলাটা পড়াবে। কবিতা আবৃত্তি শেখাবে। গান শেখাবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবে। তারা মানুষের মতো মানুষ হোক, এটা চাই। আমি আরো কিছুদিন আছি রে। মনের শক্তি আমার অনেক বেশি। আমি যেকোনো অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারি। আমি চলে গিয়েছিলাম ডিলেরিয়ামে। সেখানে ভূত প্রেত খামছে ধরছে আমাকে। সেই ছবিগুলি চোখে ভাসছে। আমি কি কি বলেছি না বলেছি আমার তা মনে নেই। সেই অবস্থা থেকে আমি ফেরত এসেছি মনের জোরে।
চারটা অপারেশন শেষ করে এখনও আমি ৮৩ বছর বয়সে নিজেকে মনে করি আটের সঙ্গে তিন যোগ করলে এগারো হয়। আমি এগারোতে আছি।”
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। শুভকামনায় মনে রাখুন এই মহান রাজনীতিককে।
আদিত্য শাহীন: সাংবাদিক, কলামিষ্ট
(প্রথম আলোর সৌজন্যে)