পথের গল্প
রেনু লুৎফা
পর্ব-১
অফিসে ঢুকতেই রিসিপশনের কর্মী দুজন একই সাথে বলে উঠলেন , “স্টিফেন এর অফিসে সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন”। স্টিফেন মানে আমাদের প্রিন্সিপাল। কি জন্য জিজ্ঞেস করার আগেই দেখি স্টিফেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে। কোন কিছু না বলেই সে ইশারা করলো তাঁকে অনুসরণ করতে। চকিতে আমার মস্তিস্ক চারিদিক ঘুরেও কোন উৎস খুঁজে পেল না। স্টিফেন এর অফিসে গিয়ে দেখি দুজন পুলিশের সাথে বসে আছেন আমাদের এক সহকর্মী। চোখে মুখে উৎকন্ঠা । তিনি চোখ তুলে আমাকে দেখলেন কিন্তু আমি তার কোন ভাব বুঝতে পারলাম না। তবে কান্নাকাটি করেছেন তা বুঝা যাচ্ছে। তার পাশে দুজন পুলিশ অফিসার। একজন মহিলা অন্যজন পুরুষ ।
অফিসের অন্য মাথায় লম্বা সোফায় আমাদের আরেক সহকর্মীর পাশে বসে আছেন একজন মহিলা। তিনি এশিয়ান। বোরকার প্রভাব তখনো লন্ডনে এতটা বিস্তৃত ছিল না। বেশ আভিজাত্য রংয়ের এক্টা সেলোয়ার-কামিজ পরনে। পায়ে একটা যুতসই জুতা। দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রঘরের মহিলা। আমার সহকর্মী বা মহিলা কেউই আমার দিকে তাকালেন না। বিষয়টি কোন দিকে এগুচ্ছে আমি নিজে কিছু আঁচ করতেও পারছিলাম না।
সময়টা ১৯৯৪ সাল। পুরো ইন্সটিটিউট জুড়ে হাজার খানেক কর্মীর মধ্যে আমরা সাড়ে তিন জন বাংগালী। একজন কলকাতার আমি সহ অন্যজন বাংলাদেশী এবং আরেক জন বাংলাদেশী বউ। সিলেটি ভাষা বলতে ও বুঝতে পারি বলে আমার বাড়তি কদর যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বাড়তি ঝামেলা। সময়ে অসময়ে প্রমানের সাক্ষ্য দিতে / দোভাষীর জন্য ডাকা হয়। জে পি হিসাবে বাড়তি দায়িত্বটিও ছিল সোনায় সোহাগা। আমার অবস্থা এক্কেবারে নাই বনে শেয়াল রাজার মতো।
আমাকে বসতে বলে স্টিফেন যা বললেন,তার মর্মার্থ হলো, এই মহিলা আমাদের সহকর্মী টির চোখেমুখে এসিড জাতীয় কিছু এক্টা ছুড়েছেন। কিছুদিন পূর্বেও কেউ একজন রাস্তায় পানি জাতীয় কিছু এক্টা আমাদের সহকর্মীকে লক্ষ্য করে ছুড়ে ছিলেন। তবে তিনি এই মহিলা কি না নিশ্চিত নয়। আজ এক্কেবারে গেইটের সামনে। মহিলাকে আটকে রাখা হয়েছ।পুলিশ ও এম্বুলেন্সও ডাকা হয়েছিল। এম্বুলেন্স এসে চলে গেছে। তারা এসিড জাতীয় কিছু ছিল বলে মনে করেনি।পুলিশ পানির বোতলটি এক্টি কাগজের প্যাকেটে ভরে হাতে ধরে রেখেছেন। মহিলা কোন কথা বলছেন না। পুলিশের হাতে মহিলাকে তুলে দেওয়ার পূর্বে স্টিফেন চাইছেন আমি যেন মহিলার সাথে কথা বলি। স্টিফেনের কথায় মনে হলো তিনি মহিলাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। আমি মহিলার সাথে কথা বলবো কোন ভাষায় জান্তে চাইলে মহিলা জানালেন তিনি বাংলায় কথা বলেন, বলেই তিনি শুরু করলেন আর থামার নাম নেই। সকলেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিজে নিজেই নিজের চারিত্রিক খতিয়ান দিয়ে যাচ্ছেন!
আমি মহিলাকে থামিয়ে তার বক্তব্যটি ভাষান্তর করতেই সকলেই একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। স্টিফেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মহিলাটির কি মানসিক সমস্যা রয়েছে বলে তোমার মনে হচ্ছে? জবাব না দিয়ে মহিলাকে প্রশ্ন করলাম,বিষয় টি কতটা মারাত্নক তা আপনি বুঝতে পারছেন? মহিলা আবার শুরু করলেন থামার নাম নেই।
স্টিফেন আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আমি তাকে বিশ্বাস করছি কি না। বুঝতে পারলাম তিনি আমার পেশদারী মতামত চাইছেন। সোজাসাপটা জবাব দেওয়া আমি বললাম আমার মতে মহিলা আসল বা সত্য কথা বলছেন না। ততোদিনে আমি মানুষ চিনতে শিখে গেছি। লম্বা দাড়িওয়ালা ১৪ বার হজ্ব করা মানুষ গুলো কোরআন হাতে নিয়ে জজের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলতে দেখেছি।
তখন আজকালকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। মহিলার বাসায় ফোন করা হয়েছ কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি। মহিলা তার ছেলের নাম্বার দিয়েছেন। ভাগ্যিস ছেলেকে পাওয়া গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলে আসলেন। কেতাদুরস্ত পোশাক পরা ছেলে। চোস্ত ইংরেজি বলছেন। মায়ের ব্যবহারের জন্য বারবার ক্ষমা চাইছেন। পুলিশ জানালেন অফিসিয়ালি তাকে সর্তক করে নোটিশ দেওয়া হবে, তবে তাকে পুলিশ স্টেশন যেতেই হবে। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কত বড় বিপদ ডেকে এনেছেন তা কি বুঝতে পেরেছেন। মহিলা আবার শুরু করলেন। ছেলে বারবার তাকে চুপ করতে বললে তিনি ছেলের উপর ক্ষেপে গেলেন। সকলের দৃষ্টি আমার দিকে। এতোক্ষনে মহিলা আসল কথা বললেন।
ছেলে ইংরাজ মেয়ের প্রেমে পড়েছে। বার বার
বাবা মার নিষেধ সত্ত্বেও ছেলেকে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। ছেলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে ঐ মেয়েটিকেই বিয়ে করবে।
উপায়ন্তর না দেখে বাবা মা মৌলভীর স্মরনাপন্ন হয়েছেন।মৌলভী মহিলাকে পানি পড়া দিয়ে বলেছেন মেয়েটির মুখে পড়া পানি ছিটিয়ে দিলে ছেলে আর মেয়ের দিকে তাকাবে না! কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আমার সহকর্মীটি ছেলেটাকে চিনেন বা জানেন না! মহিলা এবার ধীরে সুস্থে জানালেন মৌলভী তাকে বলেছেন মেয়েটির পাত্তা যখন তার জানা নেই তখন যে কোন শাদা একটি প্রতিকি মেয়ে হলেই চলবে! ছেলে আর কোন শাদা মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
এবার ঘটনা ভিন্ন মোড় নিল। স্টিফেন আমার দিকে তাকালেন আরপর দুজনেই এক সাথেই বলে উঠলাম মৌলভীকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ। সে আরেক কাহিনী। (চলবে)
রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ