পথের গল্প
রেনু লুৎফা
প্রায় ১০/১২ বছর ধরেই তাকে লন্ডনের বিভিন্ন আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশনে দেখি। প্রথম দেখেছিলাম গ্লোস্টার রোড স্টেশনে। আমাকে দেখেই কাছে এসে ভাংগা ভাংগা হিন্দিতে বললেন তার টিকেট সহ মানিব্যাগটা হারিয়ে গেছে, আমি যেন তাকে করুনা করে টিকেটের দামটা দিই। ছোট খাটো লোকটা । টেনেটুনে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা হবেন। সুরত দেখে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। টাই সহ স্যুট পরা, পায়ে দামী জুতা, মুখে ছোট ছোট দাড়ি। মাথায় একটি মোটা কাপড়ের টুপি। অপরাধীদের নাড়ীটেপা অভিজ্ঞতা,
বিশ্বাস করব কিনা ভাবছি। ভদ্রলোক আবার তাড়া দিয়ে বললেন, তিনি বিপদে পড়ে চাইছেন। জিজ্ঞেস করলাম টিকেটের দাম কত। বললেন সাড়ে তিন পাউন্ড। বললাম চলেন, টিকেট কিনে দিই। টিকেট কাউন্টারের দিকে হাটছি। পার্সে হাত দিয়ে খুচরো খুজতে গিয়ে একটি ১০ পাউন্ডের নোট বের হয়ে এলো। সাথে সাথে ভদ্রলোক বললেন এই ১০ পাউন্ডটি যেন তাকে দিয়ে দিই। নিশ্চিত হলাম তার মানিব্যাগ হারায় নি, তিনি আমাকে ঠকাতে চাইছেন। বললাম, আপনার মানিব্যাগ হারায় নি।আপনাকে আমি ট্রান্সপোর্ট পুলিশে দিব। তিনি কোন জবাব না দিয়েই দ্রুত হারিয়ে গেলেন।
এর প্রায় ৪/৫ মাস পরে দেখি বেকারস্ট্রীট স্টেশনে। আমার সাথে আমার দু’জন সহকর্মী। আবার একই অভিনয়। আমি তাকে বললাম কিছুদিন পূর্বে একই কথা বলে আপনি আমার কাছ থেকে সাহায্য চাইছিলেন এখন তো দেখছি প্রতারণা আপনার পেশা। দাড়ান আমি পুলিশ ডাকছি। ভদ্রলোক দ্রুতপায়ে সরে পড়লেন। আবার ৪/৫ মাস গেল। তারপর আবার একদিন দেখা হলো নটিংহিল গেইট স্টেশনে। সেই একই অভিনয়। সে দিন আমার সাথে যারা ছিলেন তারা দেখি তাকে আমার চেয়েও বেশী চিনেন। তারা তার সাথে সিলেটিতে কথা বলতে শুরু করলেন এবং তিনি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বিয়ানী বাজারের কোন গ্রামের পর কোন গ্রাম তার বর্ণনা দিতে শুরু করলেন ছড়ার মাধ্যমে। আমি তার ছবি তুলতে চেষ্টা করছি দেখতেই আমাদের প্লাটফরম ছেড়ে অন্য প্লাটফর্মে চলে গেলেন। তার পর অনেকদিন তাকে দেখি না। বেশ কয়েক মাস পর তার সাথে আবারও দেখা। শেফার্ড বুশ স্টেশনে। আশ্চর্য হয়ে দেখি তিনি সাহায্য চান কেবল মাত্র কালো ও বাদামী মানুষের কাছে।
এবারও আমি তার ছবি তুলছি দেখে তিনি তাড়াতাড়ি অন্য প্লাটফর্মে চলে গেলেন। উপরে উঠে ট্রান্সপোর্ট পুলিশকে বললাম। অফিসার বললেন, আমরা তাকে চিনি কিন্তু কিছু করতে পারি না৷ তিনি তো কোন আইন ভাঙছেন না। বললাম তিনি তো লোকজনের কাছে ভিক্ষা চাইছেন। ট্রান্সপোর্ট পুলিশ আমাকে শুধরিয়ে বললেন, না তিনি ভিক্ষা করছেন না। মিথ্যা গল্প বলছেন যারা বিশ্বাস করছেন,তারা টকছেন মাত্র। বললাম এটা তো প্রতারনা! আপনারা তাকে ঠেকাবেন না? তিনি বললেন এসব ননসেন্স বন্ধ করার জন্য আমাদের কাছে বাড়তি লোক নেই।আমি আন্ডারগ্রাউন্ড এ গেলেই লোকটিকে খুঁজি, মাঝে মাঝে পেয়ে যাই। তিনি আর আমার কাছে আসেন না। এবার দেখি অনেকদিন তার দেখা নেই। কয়েক দিন থেকে তার কথা বেশ মনে পড়ছে। তার ছবি আছে আমার কাছে কিন্ত তা দিয়ে একটা স্টেটাস দিতে পারি না। আমার মেয়েদের কড়া হুশিয়ারি। লোকটির জীবনে কি ঘটছে তার কিছুই আমি জানিনা। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে গেলেই আমি লোকটিকে খুঁজি।
রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ