পথের গল্প
রেনু লুৎফা
সময়টি ১৯৮৫/৮৬ সাল। খণ্ডকালীন দুইটি কাজ করি রিভারসাইড ও পার্ক সাইড হেলথ অথরিটি তে। সপ্তাহে ৫ দিন । ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত। কাজটি দোভাষীর হলেও এক সময় বুঝি পূর্ব কোন ট্রেনিং ছাড়াই হেলথ এডভোকেসির কাজটিও করছি।
টোরী দল ক্ষমতায়। ইমিগ্রেশন আইন কঠোর হতে কঠোরতম হচ্ছে। যারা দেশ থাকে পরিবার পরিজন আনতে চাইছিলেন না বা পরে আনবেন বলে ভেবেছিলেন তারাও পরিবার আনতে শুরু করছেন। ফলে স্থানীয় সরকার গুলোর অবস্থা বেহাল। পরিবাবের কর্তা ব্যক্তিটি দীর্ঘদিন ধরে এখানে অবস্থান করলেও এখানে বাড়িঘর ক্রয় করার চিন্তা না করেই দেশে বিরাট বিরাট বাড়িঘর তৈরি করেছেন।
হঠাৎ করে দেশ থেকে প্রচুর পরিবার আসতে শুরু করলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিল। বেশির ভাগ পরিবারই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করে গৃহহীন হয়ে হোটেলে উঠতে লাগলেন। স্থানীয় সরকার তাদের বাসস্থান দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। চলছে কোর্ট কাচারী। । কিংক্রস,ফিন্সব্যারি পার্ক ও বেইজওয়াটার এলাকার পর্যটকদের জন্য বাজেট হোটেলে গুলোতে গৃহহীনদের উপছে পড়া অবস্থা। পশ্চিমা পরিবেশ সম্পর্কে অভ্যস্ত নয় এমন একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হোটেলে বাস করা, বিশেষ করে রান্নাঘর এবং বাথরুম শেয়ার করতে হয় ভিনদেশী-
ভিনভাষায় লোকজনদের সাথে। লকেল অথরিটি পরিবারগুলো কে লন্ডনের বাহিরে পাঠাতে চায় কিন্ত এদের প্রায় সকলেই লন্ডনে কাজ করেন এবং লন্ডনেই তাদের সাপোর্ট সিস্টেম। অনেকেই ভাবলেন ইংরাজি শিখলেই লন্ডনের বাহিরে যেতে বাধ্য করা হইবে।
সীমাহীন দুর্ভোগ ও সমস্যার সাথে এরা বাস করছেন। সব চেয়ে বেশী সমস্যা ভাষা সমস্যা। লকেল অথরিটি স্থানীয় এড্যাল্ট এডুকেশন এর মাধ্যমে ইংরাজী ক্লাস শুরু করা হলো কিন্ত কর্তা ব্যাক্তিটি স্ত্রী কে ইংরাজি ক্লাসে দিতে রাজি নন। বাধ্যতামূলক ইংরাজি ক্লাসে নাম লিখালেও তারা নিয়মিত ক্লাসে আসেন না। হেলথ সেন্টারের ভিতরে ক্লাস খুললেও সমস্যার সমাধান হলো না বরং আমার বাড়তি কাজ হলো। টিচারগন আমাকে মহিলাদের সাথে কথা বলতে বলেন। আমি তাদের সাথে কথা বলি এবং বুঝতে পারি ইংরাজী শেখাটা তাদের কাছে গৌণ। তাদের জীবনে এখন রান্নার জন্য গোসলের জন্য লাইন দেওয়াটাই সার। তারপর যে সময়টুকু পান তা বরাদ্দ রাখেন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য। এ দিক থেকে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেই চলছে।
কিন্তু জীবন থেমে নেই। অসুখ বিসুখ জন্ম মৃত্যু সবই চলছে। তিন বাচ্চা নিয়ে হোটেলে উঠেছিলেন এখন তাদের ৪/৫ বাচ্চা। হোটেলে বাড়তি রুম বাড়তি দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার আকাশ ছোঁয়া হোটেল বিল দিতে রাজী হচ্ছে না। পরিবারগুলো কে লন্ডন ছাড়তে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। তাদের কোর্ট থেকে কোর্টে দৌড়াতে হচ্ছে পুরো পরিবার সহ।
এরই মধ্যে একদিন দেখি আমাকে দেখে ডাক্তার নার্স সবাই খুব উৎফুল্ল! ব্যাপার কি জানতে চাইলে বললেন, তুমি যে আরবি জানো তাতো আমাদের জানা ছিল না!
আমি তো অবাক, উল্টো জান্তে চাইলাম তোমাদের কে বললো আমি আরবি জানি?!
ঐ যে গতকাল একটি বড় আরবী পরিবারের সাথে তোমাকে ডাক্তার টেইলারের ক্লিনিকে দেখলাম।
সেই প্রথম আমি রিভারসাইড হেলথ অথরিটি তে বাংলাদেশী মহিলাদের সৌদি পোশাকে দেখি। স্ত্রী এবং তিনটি সেয়ানা মেয়েকে আগাগোড়া কালো বোরকা এবং ঈয়াশ্মাক পরিয়ে নিয়ে এসেছেন বাবা।
এখন তো পুরো বৃটেন জুড়েই তাই চলছে সাথে সৌদি চরিত্রের অপকর্মে সয়লাব আমাদের সমাজ।
(রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ)