পথের গল্প

 রেনু লুৎফা

এ বছরের ১লা এপ্রিল(২০২০) আমাদের কমিউনিটির একজন প্রবীন অভিভাবক খন্দকার ফরিদ উদ্দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। বার কয়েক মারাত্মক ধরনের রোগের সাথে লড়াই করে সেরে ঊঠলেও এ যাত্রা আর রক্ষা হয়নি। একবার সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ দিনের জন্য কোমায় চলে গেলেন। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিলেও তিনি দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল আশির উপরে।
আমার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। গোলাপগঞ্জ এডুকেশন ট্রাষ্টের ইলেকশনে। ফারুক আহমদ ছিলেন সাথে। বললাম একটি ছবি তুলে রাখি কখন আবার ফুড়ুৎ হয়ে যাবেন। ফারুক হেসে বললো না এত তাড়াতাড়ি যাবেন না, এর আগে আপনিও চলে যেতে পারেন। ফারুক ছবি তুলে দিল। আমরা আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিই, কিন্তু তার সাথে আমার আর দেখা হয় নাই। তারপর একদিন শুনি তিনি চলে গেছেন।
আমাদের এলাকায় তার বাড়ি হলেও খন্দকার
ফরিদ উদ্দিন কে দেশে থাকা অবস্থায় আমি কখনো দেখিনি। নাম শুনেছি বলেও মনে পড়ে না। লন্ডনেই তার সাথে আমার পরিচয়। আমার বড় বোনকে নানী ডাকতেন বলেই তিনি আমাকেও নানী ডাকতেন। এক সময় আমিও তাকে নানা ডাকতে শুরু করি।

লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিফান্ড, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রবাসীদের এমন কোন আন্দোলন নেই যার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন না। যখন কথা বলতেন, দাপটের সাথে বলতেন। যা বলতেন তার হেরফের হতো না। দেখতে অনেকটা হলিউডের নায়ক ওমর শরীফের মতো মনে হতো।

লন্ডনের নটিংহিল গেইট এ বাংলাদেশ সেন্টারের একজন ট্রাষ্টি ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে তার সাথে প্রায়ই দেখা হতো। সেন্টারের সাপ্লিমেন্টারী স্কুলের সাথে জড়িত ছিলাম। প্রতি রবিবারে সেখানে বাংলা, ইংরাজি এবং অংকের ক্লাস হতো। রেহানা আপা (রেহানা চৌধুরী) স্কুল টি পরিচালনা করতেন। আমরা ছিলাম সহযোগী শিক্ষক। রেহানা আপা তখন হ্যালেন্ড পার্ক সেকেন্ডারি স্কুলে বাংলার প্রধান।

ওয়েস্টমিনস্টার, কেনজিংটন এন্ড চেলসি এলাকা ছাড়া ক্যামডেন এলাকারও কিছু ছাত্র ছাত্রী এ স্কুলে আসতেন। আমাদের মতিন ভাই, মোহাম্মদ আব্দুল মতিন। বেইজওয়াটার এন্ড লিটল ভেনিস বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এর চেয়ার পারসন। তিনি তখন অবসরপ্রাপ্ত। মিনি বাস করে প্রতি রোববার ছেলেমেয়েদের সেন্টারে নিয়ে আসতেন এবং ক্লাস শেষে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। অভিভাবকদের কাছে ছিলেন পরম আস্থাশীল ও শ্রদ্ধার পাত্র। মরহুম আব্দুল মতিন এর বাড়ি ছিল মৌলভি বাজার। ষাটের দশকের শুরুতে টি ট্যাক্নলজির উপর ট্রেনিং নিতে লন্ডন এসেছিলেন। তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। এখানেই থেকে গেছেন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর নিজেকে নিয়োজিত রাখেন কমিউনিটির সেবায়। বাংলাদেশী পরিবার গুলোকে মূলধারার সাথে মিলেমিশে চলার তার কি না প্রচেষ্টা ছিল। প্রতিবছর স্থানীয় এলাকার ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশীদের নিয়ে উপস্থিত থাকেন। বছরে একবার ঘটা করে সমুদ্র ভ্রমনের আয়োজন করতেন।
আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের বাংলায় জি সি এস ই এবং এ লেভেল পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা টি করতেন মিসেস চৌধুরী। হ্যালান্ড পার্ক স্কুলের মাধ্যমে। স্কুলের মাধ্যমেই তাদের ফিস দেওয়ার বন্দোবন্দোবস্ত করা হতো।
নব্বুই দশকের শুরুতে স্কুল থেকে বলা হলো স্কুল কর্তৃপক্ষ আর বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার ফিস দিতে রাজী নয়। কারন হিসেবে বলা হলো বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় এতে করে স্কুল লাভবান না হয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেন্টারে তখন কাজে যোগ দিয়েছেন নতুন একজন কর্মচারী। আমাদের যতোটা সহযোগিতা পাওয়ার ছিল তা পাই না। রেহানা আপা তাকে অনুরোধ করলেন, বাংলাদেশ সেন্টারের চালিত স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের ফিসটি যেন বাংলাদেশ সেন্টার থেকেই দেওয়া হয়। সেন্টারের বেশ বড় রকমের আয় ছিল বলেই অনুরোধটি করা হয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীটি তা নাচক করে দিলেন। আমরা অভিভাবকদের অনুরোধ করলাম কিন্ত মাত্র কয়েকজনের পক্ষে তা শোধ করা সম্ভব হলো। দীর্ঘ দিনের বাংলা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাটি এইভাবে বন্ধ হয়ে যাবে তা ভেবে আমরা সেন্টার কমিটির কাছে আবেদন করলাম কিন্তু কার্যকরী কমিটি বিষয়টিকে কোন গুরুত্বই দিলেন না। আমাদের আবেদনের কোন জবাবই তারা দিলেন না। অবশেষে আমি ফোন করলাম খন্দকার ফরিদ উদ্দিন কে। বিষয় টি তাকে বলার পর জানালেন এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। কমিটির মিটিং এ বিষয়টি তোলাই হয়নি। আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, চিন্তা করবেন না আমি রবিবারে আপনাদের সাথে দেখা করছি।
পরের রবিবারে তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। দেখলেন কর্মচারী টি সেন্টারে নেই! রবিবার তার কাজের দিন, আমাদের সামনেই তাকে ফোন করে জানতে চাইলেন তিনি অফিসে নেই কেন? কর্মচারী টি কি জবাব নিয়েছেন জানতে পারি নি। তিনি জানতে চাইলেন আমাদের চিঠি সম্পর্কে তাকে বলা হয় নি কেন এবং কি কারনে কার পরামর্শে আমাদের না বলা হয়েছিল।
এর পরে আর কখনোই পরীক্ষা ফি আদায়ের ব্যাপারে আমাদের কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। বাংলাদেশ সেন্টারের সাপ্লিমেন্টারী স্কুলের ছেলেমেয়েরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ বাংলা ভাষাও।

(রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ)

You might also like