পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ও ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ

 দিলীপ মজুমদার

পরিবেশ দূষণ বা পরিবেশগত সমস্যা সম্বন্ধে মানুষ যে অবহিত নন , তা নয় । কিন্তু এই সমস্যা তাঁদের চেতনাকে নাড়া দেয় না । কারণ সমস্যাটা ‘হাতে-গরম’ নয় । মানুষ বর্তমানকে নিয়ে ভাবিত ; ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে , তা মানুষকে ততটা ভাবায় না । মানুষের এই রকম অসচেতনতা ও উদাসীনতার সুযোগ নেন রাজনীতির প্রভুরা ।অগ্রগতি বা উন্নয়নের কথা বলে তাঁরা নির্বিচারে পাহাড় ভেঙে, খাল-বিল বুজিয়ে , মাটি ও নদীকে বিষিয়ে , গাছ কেটে , বন উজাড় করে মুনাফার অঙ্ক পুষ্ট করেন ।তাই দেখা যায় পরিবেশ আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে ।

এই যে কিছুদিন আগে প্রবল বর্ষণে কলকাতা ডুবুডুবু হল , তার সঠিক কারণানুসন্ধানে কতজন মানুষ উদ্বিগ্ন ছিলেন ! সামাজিক মাধ্যমে পূরসভা ও সরকারের গাফিলতি নিয়ে কিছু যৌতুক-কৌতূক- ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হল কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য কোন স্থায়ী আন্দোলনের সূচনা হল না । যে মুষ্টিমেয় মানুষ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের কথা জানতেন , তাঁরা এই পরিস্থিতিতে তাঁকে স্মরণ করলেন , কিন্তু তিনি যে সমাধানের কথা বলেছিলেন , প্রশাসনকে সে পথে তন্নিষ্টভাবে হাঁটতে বাধ্য করতে পারলেন না ।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উঁচু কলকাতা কেন অন্যান্য শহরের মতো বর্ষায় জলমগ্ন হয়ে থাকে না তা আবিষ্কার করেছিলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগীরথীর উৎস সন্ধানের মতো সে আবিষ্কার । খাল-নালা ধরে এগিয়ে গিয়ে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন ১২,৫০০ হেক্টর বিস্তৃত পূর্ব কলকাতার বিস্তৃত জলাভূমিতে । বুঝেছিলেন এখানেই আসে কলকাতা শহরের ৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জল । তার মানে কলকাতার পাপ নীলকণ্ঠ হয়ে ধারণ করে এই জলাভূমি । শেষ নয় সেখানেই । আরও মাহাত্ম্য দেখেছিলেন এই আশ্চর্য জলাভূমির । দেখেছিলেন এখানে প্রকৃতি যেন পরিত্রাতার ভূমিকায় । প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে এবং সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখানে জল আপনা-আপনি শুদ্ধ হয়ে যায় । অন্যান্য শহরের মতো যান্ত্রিক উপায়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে জল শুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না । এই বৈশিষ্ট্যের জন্য পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বিশ্বের ১৬৯ বিলিয়ন হেক্টর জুড়ে ১৮২৮ টি আন্তর্জাতিক জলাভূমির ( রামসার সাইট ) মধ্যে অনন্য , একমেবাদ্বিতীয়ম । এখানে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এক জীবকণা । নাম তার এলগি । বর্জ্য রাসায়নিককে গ্রাস করে নেয় সেই এলগি । কেবল তরল বর্জ্য নিষ্কাশন ও তার শুদ্ধিকরণ নয় , শহর কলকাতার দূযিত বাতাস থেকে প্রায় ৬০% কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় এই জলাভূমি । তাই এখনও পর্যন্ত চিনের মতো কলকাতার মানুষকে পকেটে অক্সিজেনের বোতল নিয়ে ঘুরতে হয় না । তাই এই জলাভূমিকে ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ‘কলকাতার কিডনি’ বলে অভিহিত করেছিলেন ।

এই জলাভূমিতে আছে ৫৮৫২ হেক্টর জলাজমিও ভেড়ি , ৪৭১৮ হেক্টর নিচু ধানের জমি , ৬০২ হেক্টর সবজি ও চাষের জমি, ১৩২৬ হেক্টর বসত জমি । এখানকার ভেড়ি থেকে ১১০০০ টনের বেশি মিষ্টি জলের মাছ — রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, মৃগেল, সিলভার কার্প, চারাপোনা – উৎপন্ন হয় । তাই তো কলকাতায় এখনও ‘মাছভাত’ পাওয়া যায় এত সস্তায় । মাছের সঙ্গে আসে টাটকা সবজি । হিসেব বলে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টি করে এই জলাভূমি । রাজবংশি, বাগদি, নমশুদ্র সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ এই জলাভূমি থেকে নির্বাহ করে জীবিকা ।বামপন্থায় বিশ্বাসী ধ্রুবজ্যোতি তখনকার শাসকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এই জলাভূমির গুরুত্ব । মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকেও তিনি না কি নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে । তাঁকে বোঝানোর জন্য জলা থেকে জল তুলে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে পান করেছিলেন অবলীলাক্রমে । কিন্তু রাজনৈতিক প্রভুদের কাছে জলাভূমির বিশুদ্ধতার চেয়ে তার বিক্রয়মূল্য অনেক কাঙ্খিত । হাতে আসছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভলাপমেন্ট ব্যাঙ্ক প্রভৃতির কোটি কোটি টাকা । ফাঁকা জায়গায় হবে নিত্য-নতুন প্রকল্প । । ১৯৯২ সাল । বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত করলেন জলাভূমির ২২৭ একর জমি ভরাট করে গড়ে তুলবেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র । ভাগ্যিস ছিলেন বনানী কক্কর । তাঁর পি আই এলের ফলে হাইকোর্ট রায় দিলেন যে জলাভূমি ভরাট করা চলবে না । ধর্মযোদ্ধা থেমে নেই তখনও । তাঁর চেষ্টায় ২০০২ সালে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ‘রামসার’ স্বীকৃতি পেল । রাজনৈতিক প্রভুরা থমকে গেলেন । বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক রায়ে ( দ্য ইস্ট কোলকাতা ওয়েটল্যান্ড –কনজারভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৬ )এই জলাভূমিতে জমি কেনা ও বেচা নিষিদ্ধ হল । এর বাস্তুতন্ত্রের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেওয়া হল সরকারকে । মহামান্য আদালতের নির্দেশে কিছু এসে যায় না রাজনীতির মাতব্বরদের । যে বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ, সেই বামপন্থার নেতারা তাঁর কথায় বিশ্বাস করেন নি । তলে তলে চলছিল অসাধু কাজের আয়োজন । তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের কথা , প্রকৃতি জয়ের চেষ্টা যেন মানুষ না করে রাজ্য জয়ের মতো ; তা হলে প্রকৃতি নেবে প্রতিশোধ । কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হতে লাগল এই ‘মুক্তাঞ্চলে’ । ভরাট করার এও এক ধীর কৌশল । লোকালয়ের পুকুর ভরাট করার কৌশলের মতো । ‘ছিল পুকুর হয়ে গেল ফ্ল্যাট’ এর ম্যাজিক । বি এল এর ও-র নথিতে যা লেখা আছে তাকে বদলানো তো বাঁয়ে হাতকা খেল ।

২০১১ সালে সরকারের রঙ বদল হল কিন্তু জলাভূমির প্রতি চরম উপেক্ষার কোন পরিবর্তন হল না । বিশেষজ্ঞরা বলেন ২০০৬-২০১৬ পর্যন্ত ঐতিহাসিক জলাভূমির ক্ষতি হয়ে গেছে ৭০% । ২০১৭ সালে পশ্চিনবঙ্গের বিধানসভায় আনা হল একটি বিল । সেখানে পরিবেশমন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জীকে করা হল ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যাণ্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটির চেয়ারপার্সন । অথচ শোভনবাবুর জলাভূমির প্রতি বিরাগ ও বিদ্বেষ সুপরিচিত ছিল । তিনি তো জলাভূমির চরিত্র বদলেরই পক্ষপাতী ছিলেন , তাঁর মতে এই জলাভূমির জন্য নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাধা পাচ্ছে । রামসার কনভেনশনে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুললেন তিনি । ধাপার কাছে সোলার প্রজেক্ট, ৬.৫ কিমি ফ্লাই ওভার তৈরি , ইকো পার্ক নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা দূর করা—এ সব স্বপ্নে বিভোর তিনি । তাঁর কথাবার্তার গন্ধটা সন্দেহজনক বলে মনে হল পরিবেশবিদদের কাছে । সঙ্গত কারণে তাঁরা মনে করলেন যে এই অঞ্চলে যে সমস্ত বেআইনি নির্মাণ হয়েছে , মন্ত্রী তাদের আইনি ছাড়পত্র দিতে প্রস্তুত হচ্ছেন ‘ জলাভূমির যথাযোগ্য ব্যবহারের ‘ কথা বলে । ২০১৭ সালের মার্চ মাসে রামসার সম্পাদকমণ্ডলীর কর্তা মিঃ ইয়ং কলকাতায় এসে জলাভূমির যথাযোগ্য ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছিলেন । শোভনবাবু সেটা তাঁর নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন । অথচ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এস এ এফ ই – আই ডব্লু এম আই তাঁদের একটি সমীক্ষায় দেখিয়ে ছিলেন বন্যাপ্রবণ কলকাতাকে রক্ষা করতে পারে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ।

পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত এই জলাভূমি সমীক্ষা করে এতে যে সমস্ত বেআইনি নির্মাণ আছে তার তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন । ‘সবুজ মঞ্চে’র নব দত্ত দেখিয়ে দিয়েছিলেন এখানে ৮৭ টি আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে । তাঁদের এই বক্তব্য প্রভাবিত করে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালকে । পিপল ইউনাইটেড ফর বেটার লিভিং নামক এনজিওর এক মামলার ফলে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের বৈদিক ধর্ম সংস্থানের সৌধটি এবং মুনশির ভেড়ির চারধারে নবদিগন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অথরিটির রাস্তা ভেঙে দেবার , অন্যথায় প্রত্যেককে ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা দেবার নির্দেশ দেয় । ১৯১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল আদেশ দেয় একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করার । এই টাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দেবেন চিফ সেক্রেটারি , থাকবেন কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রবীণ বিজ্ঞানীরা , থাকবেন উত্তর ও চব্বিশ পরগণার জেলশাসকরা । এই টাস্ক ফোর্স খতিয়ে দেখবে বেআইনি প্লাস্টিক প্রসেসিং ও রিসাইকেলিং ইউনিটগুলির আগ্রাসনের অভিযোগগুলি , বিধাননগর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন যাতে আবর্জনা জমা না করতে পারে তার জন্য মোল্লারভেড়ির চারধারে কাঁটাতারের বেড়া দেবার নির্দেশ দেয় ট্রাইবুনাল ।জলাভূমির ধর্মযোদ্ধা ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ চলে গেলেন ২০১৯ সালে । শেষ দিকে তিনি যেন একটু হতাশ হয়েছিলেন ছিন্নমস্তা মানুষের কাণ্ড দেখে । নিজেকে তাই ‘ব্যর্থ প্রকৃতিবিদ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি । কিন্তু তিনি কি সত্যই ব্যর্থ হবেন । আশাবাদী রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মানুষের কর্মসাধনা ‘জানি হে জানি তাহা হয় নি হারা ‘ । তাই আমরা আশা করব,ভবিষ্যতে রাজনীতির প্রভুদের অগ্রাহ্য করে জলাভূমির আরেক ধর্মযোদ্ধা আবির্ভূত হবেন ,কলকাতার কিডনিকে রক্ষা করবেন , কলকাতার খালগুলির সংস্কার করবেন , চড়িয়াল খালের মতো কোন খাল বুজিয়ে তার তলায় জলনিকাশিপাইপ বসানোয় বাধা দেবেন ।

লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

You might also like