বাজেট ও বৈহাসিকের ভাবনা

 রুহুল কুদ্দুস বাবুল

১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন- “সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। এ কথা সবার মনে রাখা দরকার শুধু স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না, দুর্নীতি দূর হয় না, শুধু বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় না। এতে শুধু সাধারণ জনগণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে।”
জননেতা তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের প্রথম বাজেট ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই প্রবাসী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রণীত হয়, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাজেটের অনুমোদন দিয়েছিলেন। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৮ হাজার ২০৭ রুপি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রীও হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। দায়িত্ব নিয়েই তাঁকে একসঙ্গে দুটি বাজেট নিয়ে কাজ করতে হয়। একটি হচ্ছে ১৯৭১-৭২ অর্থবছরের জন্য। এর সময়কাল ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। আরেকটি পরবর্তী অর্থবছর ১৯৭২-৭৩-এর জন্য। নতুন অর্থমন্ত্রী দেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। তিনি একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন।
৯ জুন ২০২২ সালে দেশের ৫১ তম বাজেট পেশ করেছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মোস্তফা কামাল। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট এটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেটের শিরোনাম করেছেন- “কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন”।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর–বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
আমাদের জাতীয় বাজেট ৭ কোটি থেকে ৭ লক্ষ কোটিতে পৌছেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫১ বছরে। আমাদের উন্নতি হয়েছে সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও ধনী ও গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীত। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে সবকিছু । রাজনীতিতেও নীতি, আদর্শ, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। বৈষম্য রেখে উন্নয়ন অর্থবহ হয়না, সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, কর্তৃত্ববাদীদের কবলে। সাধারণ মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক মুক্তি, নিরাপদে শান্তিতে জীবনযাপনের নিশ্চয়তার কাঙ্খিত বাজেটের এখনও দেখা মেলেনি।
দেশের রাজনীতি অসৎ ব্যবসায়ী, স্বার্থান্বেষী ও লুটেরা দুষ্ট চক্রের হাতে বন্দি। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা চেতনার কথা বলা হলেও বাস্তবে চলে উল্টোধারা। লক্ষকোটি টাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থানের জন্য যে উন্নয়ন সেটা নেই। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার তৈরী হচ্ছে। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছেনা, গার্মেন্টস শিল্পের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোন শিল্প নেই। রফতানির চাইতে আমদানি বেশি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রবাসীদের অবদানই প্রধান। বিগত কয়েক বছর থেকে বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অতিমাত্রায় ঋণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর ঋণের মাত্র ১১ শতাংশ পেয়েছে বেসরকারি খাত। এ অবস্থায় সরকার ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আরও বাড়ালে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমতেই থাকবে। বেশি বেশি রফতানিমুখি শিল্প গড়ে না উঠলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি হবে, অর্থনীতিতে বিপর্যয় আসতে পারে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে ৭.৫ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভবই হবে।
দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ দরকার। খাদ্য উৎপাদনে অর্থাৎ কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যাবহার, পোল্ট্রি, ক্যাটেল, ফিশারী, সব্জি, মসলা ও ফল উৎপাদনে মনযোগ জরুরী। এসব খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তার উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দরকার। সহজে হয়রানিমুক্ত জামানতবিহীন ঋণের সুযোগ দরকার। এ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব খাত অবহেলিতই থাকলো। এসবের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন কর্পোরেটদের হাতে চলে যাচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্যোগে দেশের সাধারণ মানুষ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নাস্তনাবুদ। সবকিছুই তাদের হাতে, সরকার অসহায়। তাই নিত্যপণ্যের উৎপাদন বাজারজাতকরণ ক্ষুদ্র ও মাঝারী পর্যায়েই রাখতে হবে। ব্যাংক ঋণ পেতে আয়কর রিটার্ণ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হয়রানিতে পড়বে। বিষয়টা বিবেচনায় নেয়া উচিৎ।
চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে ভোগান্তি যখন চরমে বাজেটে তাঁদের প্রত্যাশার প্রতিফলন নেই। ভোগান্তি কমাতে কোনো কিছুই থনেই। মধ্যবিত্তের উপর চাপ কমানোর তেমন উদ্যোগ নেই, বরং বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব তাদের বাড়তি চাপে ফেলবে, ভোগান্তি বাড়াবে, খরচও বাড়বে।
আমাদের দেশ বর্তমানে ‘অবাধ পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতি’র নীতি-দর্শনের ভিত্তিতেই পরিচালিত হচ্ছে। পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে খুনি মোশতাকের দ্বারা সূচিত এই দর্শনের ভিত্তিতেই দেশ চালিয়েছেন জিয়াউর রহমান, হোসেইন মোহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া। বর্তমান সরকারও একই ব্যবস্থাগত কাঠামো অনুসরণ করেই দেশ চালাচ্ছেন। অর্থনীতির এ দর্শন দেশে লুটেরাধারার রাজনীতি তৈরী করেছে আর এ রাজনীতি তৈরী করছে একটা লুটেরা শ্রেণী। তাদের মুঠোয় সবকিছু চলে গেছে । তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়। তাদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয় বাজেটে। এবারের বাজেটে এদের পাচার করা অর্থ ৭% কর দিয়ে ফেরত আনার ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য। যারা অর্থ পাচারকারী তারা তো দেশের প্রচলিত আইন ভেঙেছে। এ ধরনের উদ্যোগ নীতি নৈতিকতা ও আইনের লঙ্ঘন। পাচার হওয়া টাকা কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ অবশ্যই বেআইনি। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হবে। দেশের কতিপয় মানুষ লুটপাটের অর্থনীতির আবহে এমনিতেই অতিলোভী হয়ে পড়েছে। সর্বত্র যেন শুধু খাই খাই ভাব। মানুষকে যখন টাকার লোভ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার কাঠামোয় অভ্যস্ত করা জরুরী তখন অবৈধভাবে অর্জিত পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বৈধতা দেয়ার কারনে আরও একশ্রেণীর মানুষ বেপরোওয়া হয়ে উঠবে।
চলমান এই পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.রেহমান সোবহান “ফ্রম টু ইকোনোমিস টু টু নেশনস: মাই জার্নি টু বাংলাদেশ” গ্রন্থে লিখেছেন- “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বাধীনতাযুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে জীবন দিয়েছে তাদের ঋণকে সম্মান জানাতে ব্যর্থ হওয়া। প্রকৃত অর্থে জনগণের এই ব্যাপক অংশগ্রহণই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। … একটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সমাজ বিনির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান ও গণতান্ত্রিক অধিকার সাধারণ মানুষের হাতে ন্যাস্ত করতে হবে। কিন্তু আমরা তার বদলে অধিকতর অযোগ্য সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে স্বাধীনতার সুফল খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হয়েছে এবং তারা সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।”
দেশে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের তুলনায় ফটকাবাজি, পরগাছাবৃত্তি, তদবির বাণিজ্য, বিদেশি পুঁজির কমিশন এজেন্ট হওয়া ইত্যাদি প্রধান হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের প্রবণতাগুলো অর্থনৈতিক প্রণোদনা পাচ্ছে । সমাজ ও অর্থনীতিতে অপরাধবৃত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদের পাহাড় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বিত্তবানের সংখ্যা ও তাদের বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই বিত্ত বিনিয়োজিত হয়ে ‘পুঁজি’তে পরিণত হচ্ছেনা। বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। লুটপাটের অর্থনীতির দর্শনের কাছে নিঃশেষিত হচ্ছে সবধরনের নীতি-নৈতিকতা বোধ।
হ্যা তবুও এগিয়েছে দেশ আজ মাথাপিছু আয় ৩ লক্ষ টাকারও উপরে। অংক করে সেটা দেখানো সম্ভব প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মাথাপিছু আয় তিন লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষের আয় কি বেড়েছে ? ‘মাথাপিছু গড় আয়’ আর ‘প্রত্যেকের আয়’ আয় কি এক ? ১% আর ৯৯% -এর গড় আয়ের অংকে তো বৈষম্য দূর হবেনা।
একটা গল্প দিয়েই শেষ করতে চাই। একজন গণিতবিদ, একজন হিসাবরক্ষক, আরেকজন অর্থনীতিবিদ আবেদন করেছেন একটা পদের জন্য। তাঁরা একে একে হাজির হলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে।
দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়? প্রশ্নকর্তা গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করছেন।
গণিতবিদ বললেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়।
হিসাবরক্ষক বললেন, দুই আর দুই যোগ করলে গড়ে চার আসবে। তবে টেন পারসেন্ট এদিক-ওদিক হতে পারে।
আর অর্থনীতিবিদ ঝুঁকে বসলেন প্রশ্নকর্তার দিকে। স্যার, আপনিই বলুন, দুই আর দুইয়ে ঠিক কত হলে আপনার চলবে। আমি মিলিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশে এক অপার সম্ভাবনার দেশ। নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও সততায় পদ্মাসেতুর মত অর্জন সম্ভব হয়েছে। রাজনীতিতে সুস্থ ধারার চর্চা ও গণতন্ত্রের যথার্থ বিকাশ হলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ আরও উঁচুতে উঠতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
রুহুল কুদ্দুস বাবুল: রাজনীতিক, সাবেক ছাত্রনেতা
e-mail: babulrq.syl@gmail.com

You might also like