বিচারের বাণী
দিলীপ মজুমদার
এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে অনেক সুবিধা।এক সঙ্গে ছবি দেখা যায়,শোনা যায় কথা।অকাট্য প্রমাণ।সেই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে আমরা দেখলাম উত্তরপ্রদেশের হাসরথ গ্রামের একটি ঘটনা।সে গ্রামের বাল্মীকি সম্প্রদায়ের দলিত পরিবারের এক তরুণীকে কারা খেতের মধ্যে ধর্ষণ করে খুন করেছিল।হাসপাতালে ছিল সে।মারা যায় সেখানে।তার পরের কাণ্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে আমরা দেখতে লাগলাম ।হাসপাতাল থেকে পুলিশ মৃতদেহ দখল করল।তরুণীর পরিবার তার দেহ পেল না শেযকৃত্য করার জন্য । গ্রামের কাছে কোন এক জায়গায় মধ্যরাতে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিল পুলিশ।আমরা জানতে পারলাম ধর্ষণের পরে তরুণীটির জিভ কেটে ফেলা হয়েছে, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার মেরুদণ্ড ।
আমরা দেখলাম পরিবার ও গ্রামটিকে ঘিরে ফেলল পুলিশ । বাইরের কোন অনভিপ্রেত মানুষ যেন গ্রামে ঢুকতে না পারে । পরিবারের লোকেরা যাতে কোন খবর না পাঠাতে পারে । পরের দিন জেলা শাসকের আবির্ভাব । তাঁকেও দেখতে পেলাম।তাঁকে দেখে ও তাঁর কথা শুনে ধন্য হলাম । ধর্ষিতার পরিবারকে টাকার লোভ দেখানো হল ।বিশাল অঙ্ক । করোনা সংক্রমিত হলেও যে এত টাকা পেত না, সে কথা বললেন তিনি।তারপরে মুখ খোলার ব্যাপারে ভয় দেখানো হল ।তার পরের দিন আবার নাটক ।দুই নাছোড়বান্দা মহিলা সাংবাদিককে দেখলাম । তাঁরা গ্রামে ঢুকে সেই তরুণীর পরিবারের কাছে যেতে চান । পুলিশ তাঁদের আটকাচ্ছে । কোন আদেশবলে আটকানো ? সাংবাদিকরা জানতে চান । উপরওয়ালা বলাটা যথেষ্ট নয়, সেই উপরওয়ালা কে ? পুলিশ তখন নীরব । আটকানো হল রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও ।
কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কেরামতিতে তখন খবর ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল । তাই সরকার সিবিআই তদন্তের আদেশ দিলেন । ভাবটা এমন যেন, এই তো বিচারের ব্যবস্থা হল । দোষীরা শাস্তি পাবে । সঙ্গে সঙ্গে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে কত ছবি… কত খুন, কত রাহাজানি, কত লুঠ, কত কেলেঙ্কারী… । কটা সুবিচার দেখেছি আমরা ? ন্যায়চঞ্চুদের ডিগবাজি দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি । পকেটের জোর থাকলে, রাজনীতির মাতব্বরদের সঙ্গে দহরম-মহরম থাকলে বিচারের একটা আশা থাকে, তা না হলে মরীচিকা ।এই তো ৩০ সেপ্টেম্বর আমরা দেখলাম । ২৮ বছর ধরে মানুষ যাদের দোষী বলে মনে করত, তারা নির্দোষ হয়ে গেল এক লহমায় । আদালত তাদের দিল বেকসুর খালাস । বলার মতো কথা ছিল আদালতের । কি না, এরা যে দোষী, তার ঠিক ঠিক প্রমাণ হাজির করা যায় নি । সেদিনের খবরের কাগজ, সেদিনের সংবাদিকদের প্রতিবেদন, সেদিনের ক্যামেরায় ধরা ছবি, সব মূল্যহীন হয়ে গেল । আদালতের রায় বলে কথা ! তার বিরুদ্ধে গলাবাজি করা যা্য় না । শুধু এই রায়ের বলে এতদিনের সত্য মিথ্যে হয়ে গেল । হাসরথের এই দলিত মেয়ের কপালে সে রকম কিছুই লেখা আছে হয়তো । হয়তো দেখা যাবে আদালতের রায় বেরোতে এক যুগ লেগে যাবে, মানুযের মনের ক্ষোভ ও ক্রোধ ঝিমিয়ে যাবে, ন্যায়চঞ্চুরা প্রমাণ করে দেবেন, যাদের ধর্ষক বলা হচ্ছিল, তারা ধোয়া তুলসিপাতা ।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আইন-আদালত ও আইনের রক্ষকদের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করতে পারি কি ? না, পারি না । আমাদের অভিজ্ঞতাই সে কথা বলে । শাসকদের পক্ষে যায় তারা, শাসকদের প্রত্যাশিত কথা বলে, রায় দেয় । তা না হলে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, যৌক্তিকতা সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে শুধু ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তিতে অযোধ্যা রায় কি সম্ভব হত ?
আসলে রাজনীতির করাল ছায়া আমাদের সমাজ-সংসারকে গ্রাস করে বসে আছে । সব কিছুরই রাজনীতিকরণ হয়ে চলেছে । ধর্ষণের রাজনীতিকরণ, খুনের রাজনীতিকরণ, নানাবিধ কেলেঙ্কারির রাজনীতিকরণ । কিন্তু ‘রাজনীতি’ থেকে লুপ্ত হয়েছে ‘নীতি’ । রাজনীতি এখন পণ্য । এর মধ্যে ঢুকে পড়লে বাহুবলী হওয়া যায়, সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া যায়, যে কোন বিষয়ে ছড়ি ঘোরানো যায়, দেশের তহবিল কেটে ফাঁক করে দেওয়া যায়, অল্প মেয়াদে জেলে গেলেও অনতিবিলম্বে বেকসুর খালাস হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে গ্যাঁদাফুলের মালা পরে আবার নেতা হওয়া যায়, যে দলে আছি সে দলের ক্ষমতা কমে গেলে টুক করে অন্য দলে ঢুকে পড়া যায় । আচ্ছা, এই রকম আবহাওয়ায় ‘গণতন্ত্র’টা বেঁচে থাকে কি ভাবে ? বেঁচে থাকতে পারে কি বিচারের সঠিক বাণী ?
(লেখক: কলকাতার অধিবাসী, সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ও লেখক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)