বিজেপির বিজয়রথ থেমে গেল সাতের ঘরে
দিলীপ মজুমদার
একটা দারুণ আক্ষেপ থেকে গেল। এবারে বিধানসভার ভোট দিতে পারলাম না। করোনায় আক্রান্ত গোটা পরিবার। ঘরবন্দি হয়ে কাটাতে হল। ভোট দেবার ব্যাপারে আমাদের উদগ্র আগ্রহ যে আছে , তা নয়। কিন্তু এবারে ছিল। এবার ভোট দিতাম এবং তৃণমূলকেই দিতাম। তার মানে এই নয় যে আমরা তৃণমূলের অন্ধ সমর্থক। কর্মী হবার প্রশ্ন ওঠেই না। তাহলে তৃণমূলকে ভোটটা দিতাম কেন? বিশেয যখন, আমাদের এলাকার তৃণমূল প্রার্থী মোটেই পছন্দের নয়! আমার এক বন্ধু রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তিনি নোটায় ভোট দেন। আমাকেও বলেছিলেন। গতবার নোটায় ভোট দিয়েছিলাম। এবার সে সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেছি অনেকদিন আগে থেকে।
এবারে যে কারণটা বলব সেটা আমার বামবন্ধুদের একদম পছন্দ হবে না। তাঁরা তাঁদের ফাটা রেকর্ডে যে গান বাজিয়ে চলেছিলেন, সে গানের অর্থ মোদি ও মমতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুজনেই পরম শত্রু, দুজনের বিরুদ্ধে তাঁদের কঠিন লড়াই। এ কথা ঠিক যে একদা মমতা এন ডি এ মন্ত্রীসভায় ছিলেন। তাঁর অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি রাজ্যে বিজেপিকে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। অতীতের কোন কোন বিজেপি নেতার সঙ্গে হয়তো মমতার সখ্যও আছে। অতীতের কথা যদি ওঠে, তাহলে তো বলতে হয় বামেরাও বিজেপির সাহায্য নিয়েছিলেন একদা। এবারের পরিস্থিতিটা যে ভিন্ন, সে কথা বামবন্ধুরা বুঝতে চান নি। অথবা একা এক নারী মমতা তাঁদের যে গো-হারান হারিয়েছিলেন, সেই যন্ত্রণা ও রাগটা তাঁরা কিছুতেই ভুলতে পারেন নি। সি পি আই এম লিবারেশনের দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথা তাই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি তাঁরা। বিজ্ঞজনদেরও পরামর্শ কানে তোলেন নি। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত করে ২০১৯ এ ডুবেছিলেন, এবার তো একেবারে তলিয়ে গেলেন।
বামবন্ধুদের কথা থাক। যে আমি তৃণমূলের সমর্থক নই, সে আমি কেন এবার দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে এবার তৃণমূল জিতুক। কাটমানি ও তোলাবাজির সঙ্গে এই দলটি যে জড়িয়ে গেছে, এ কথা কিছুটা জানা সত্ত্বেও আমি কেন চেয়েছি যে এই দল জিতুক?
গতবছরের শেষ থেকে দেখছিলাম দিল্লির সরকার ও বিজেপি দলটি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে দারূণ গুরুত্ব দিচ্ছে, নানা পরিকল্পনা করছে। এ বছরের শুরুতে তো তারা এ রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে। ‘ঝাঁপিয়ে পড়া’ শব্দ দুটি আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি। যেমন বাজপাখি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের উপর। হ্যাঁ, এবারের ভোটে বিজেপির শিকার ছিল রাজ্যের তৃণমূল দল, বিশেষ করে সেই একা এক নারী, যাঁর সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছেন না রাজ্য বিজেপির কঠোর আর দুর্মুখ নেতারা। প্রবল পুরুষতন্ত্রে আঘাত লাগবে না? নারীকে যাঁরা সন্তান উৎপাদন ও গৃহকর্মে আবদ্ধ দেখতে চান, তাঁরা এটা মেনে নেবেন কেন? যোগী আদিত্যনাথ প্রকারান্তরে একথা বলে গেছেন। আ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। নারীশাসক হিসেবে তাই মমতার বিরুদ্ধে তাঁদের জেহাদ। তাছাড়া দেশের পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের কাঁটা হয়ে আছে এই নারীরই দল তৃণমূল।
জেহাদ বলে জেহাদ। বামবন্ধুরা কী দেখতে পান নি দৃশ্যপট! নাকি, দেখেও দেখতে চান নি! বারে বারে ছুটে আসছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং ডজন ডজন নেতা। প্লেনে. হ্যালিকোপ্টারে, ট্রেনে। এখানকার রিসোর্ট, হোটেল দখল করে থাকছেন করোনা ছড়াতে ছড়াতে। হাওয়ায় উড়ছে টাকা। বঙ্গনেতাদের উপর ভরসা করতে না পেরে হাল ধরছেন তাঁরা নিজেরাই। প্রার্থী নির্বাচন করছেন, রণকৌশল ঠিক করে দিচ্ছেন, মধ্যরাতেও অমিত শাহের নিদ নাহি আঁখিপাতে, তিনি সভা করছেন কর্মীদের নিয়ে। এরপরেও বলবেন মোদি ও মমতার মধ্যে গোপন বোঝাপড়া আছে? মোদি ও মমতা এক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ?
তোলাতোলা আর কাটমানি খাওয়া তৃণমূল আর বিজেপিকে সমান সমান শত্রু ভেবেছেন বাম ও কংগ্রেস। এই ভাবনাটাও কী সঠিক! গোটা দেশটাকে যাঁরা হাতে ও ভাতে মারছেন, অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিতে পচন ধরাচ্ছেন, পুরাণকে বিজ্ঞানের জায়গা দিচ্ছেন, কোন বিশেযজ্ঞকে পাত্তা দিচ্ছেন না, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্লোগান যাঁদের তীব্র আগ্রাসনের সঙ্গে এক হয়ে আছে, ভাগ করে ভোগ করা যাঁদের ঘোযিত নীতি, সেই বিজেপি আর তৃণমূলকে এক বলে মনে করাটা সুস্থ মানুষের লক্ষণ নয় ।
কিন্তু আমি যেমন ভাবছি, রাজ্যের মানুষ তেমন ভাবছেন কী। এইখানটায় ভয় ছিল আমার। তাঁরা তাঁদের অজ্ঞতার, বিপুল প্রলোভনের অচেতন শিকার হয়ে যাবেন না তো? ভাগ হয়ে যাবে নাতো সংখ্যালঘু ভোট? আমার বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক হয়েছে এসব নিয়ে। তাঁরা তৃণমূলের দুর্নীতি আর অত্যাচারের কথা বলেছেন। বলেছেন, এসবের জন্য তিক্ত-বিরক্ত মানুষ বিজেপিকে ভোট দেবেন; বলেছেন তরুণ প্রার্থী দেওয়ার জন্য বামেরাও এবার ভোট পাবেন। বেশ জোর দিয়ে বলেছেন তাঁরা। শুনে ভয় পেয়েছি। ভয় পেয়েছি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের, দিলীপ ঘোষ আর শুভেন্দু অধিকারীর প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠস্বরে। নির্বাচনের প্রতিটি ফেজে তাঁরা বলে দিচ্ছেন কত আসন তাঁরা জিততে চলেছেন। কোন কোন সাংবাদিক একে মাইন্ড গেম বললেও মনের ভেতরে ভয় থেকে গেছে। ভয় পেয়েছি সমীক্ষা দেখে। তৃণমূল জিতছে, কিন্তু এত কম আসনে যে টাকার ঝুলিতে তাঁদের অনেককে বশ করে টেনে নেওয়া যাবে।
আমাদের টিভিটা অচল হয়ে পড়েছিল। ২রা মে ভোট গণনা। আর আগের দিন আমার স্ত্রী বলল টিভিটা সারাবার জন্য। কান দিই নি। সেই ভয়। যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে! তারপর সাংবাদিক বন্ধু জাইদুল হকের ফোন পেলাম বেলা দশটা নাগাদ। বহু আসনে এগিয়ে আছেন তৃণমূল প্রার্থী। সাততাড়াতাড়ি ডাক দিলাম রিন্টুকে। সারিয়ে দিয়ে গেল টিভি। বলে গেল ক্রিকেটপ্রেমী রিন্টু, ছক্কা হাঁকাচ্ছে। তারপরে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে দেখতে লাগলাম সেই ছক্কা হাঁকানো। দেখতে দেখতে ডবল সেঞ্চুরি। বিজেপি আটকে রইল সাতের গণ্ডিতে। বাম আর কংগ্রেস পারল না খাতা খুলতে। তৃণমূল জিতল, কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা আমার বাংলা বেঁচে গেল। বেঁচে গেল মহামানবের সাগরতীর বাংলা।
কিন্তু শুধু বাংলা বাঁচলে তো হবে না। বাঁচাতে হবে গোটা দেশটাকে কপট সাধু-সন্তদের হাত থেকে। অথচ বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চলেছেন মোদি আর অমিত শাহের দল। কংগ্রেসের উপর ভরসা করে লাভ নেই। এখন তার নেতাও নেই, নীতিও নেই। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে আঞ্চলিক দলগুলিকে। যে লড়াই মমতা করেছেন, তাতে অক্সিজেন পেয়েছে বিরোধীদলগুলি। হিন্দি হার্টল্যান্ডের মিথটাকে উড়িয়ে দিয়ে বিজেপিবিরোধী ভারতব্যাপী আন্দোলনের রাশ মমতাকে নিতে হবে। নেবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যে প্রস্তুতি জ্যোতি বসুর ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁকে আমরা বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে পেলাম না। দরকার নেই প্রধানমন্ত্রীর পদ। বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে মমতা যদি বিজেপির বিরুদ্ধে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূচনা করতে পারেন, তাহলেই অনেক।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মমতা যখন মসনদে বসতে যাচ্ছেন, তখন সামনে অনেক বাধাবিঘ্ন। বড় বাধা করোনা। যাকে খুব পরিকল্পনামাফিক ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন একদল। করোনায় ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়েও ভারতব্যাপী আন্দোলনের সূচনা হতে পারে।
মমতা যাদি আত্মসমীক্ষা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন এর আগে তিনি সঠিকভাবে রাজধর্ম পালন করেন নি। এবার সেদিকে তাঁকে কঠোরভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। রাজ্যের যেসব দিকে, যেমন শিক্ষা-শিল্প, ঘাটতি আছে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রেজুডিসকে, দলীয় সংস্কারকে অতিক্রম করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। এ কথা নিন্দুককেও বলতে হবে যে মমতার মধ্যে শক্তি আছে। তাই তিনি যেন সংকীর্ণক্ষেত্রে ডাক না দেন।
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।