ভোটরঙ্গ জোটরঙ্গ
দিলীপ মজুমদার
রাজনীতির গাম্ভীর্য যে আর নেই,রাজনীতি যে খেলায় পর্যবসিত , সে কথা আমরা জানলেও তেমন করে বুঝতে পারি নি।দেবাংশু ‘চোখে আঙুল দাদার’ ভূমিকা পালন করলেন । গত বিধানসভার নির্বাচনে তিনি স্লোগান তুলে দেখিয়ে দিলেন সেই খেলার ইতিকথা । দাদা-দিদি , ভাই-বোন ,কাকা-কাকি , জেঠা-জেঠিরা সব্বাই খেলায় সামিল হলেন । বড়দিমণি তো আস্ত একটা ফুটবল নিয়ে দেখা দিলেন রঙ্গমঞ্চে । বেশ কয়েকটি দিন করোনার আতঙ্ক ভুলে আমরা সবাই , মানে হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তরা , মশগুল ছিলাম । প্যাটের খিদে ভুলে যোগ দিয়েছিলাম খেলায় ।
নিন্দুকেরা ভেবেছিল ভোটের ফল বেরোবার পরে বুঝি শেষ হয়ে গেল সে খেলার । রাজনীতির খেলার যে শেষ হয় না, সে কথা বুড়বকরা বুঝতে পারে নি । রাজনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ভোট । আর ভোট মানেই খেলা । ছ্যাবলামি করে তাকে ছেলেখেলা বললে গণতন্ত্রবাবু বড্ড রাগ করবেন । বিধানসভার ভোট শেষ হল তো কি , লোকসভার ভোট আসছে না ! প্রায় এসে গেল ২০২৪ । আর নেই রে দেরি , ত্বরা করে হাতে হাত ধর গো ।এবারের লোকসভা ভোটে খেলা হবে জোটের । কেউ কেউ আবার জোটকে ঘোঁট বলেন । গত দশ বছরে বিজেপির আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে । বলে কয়ে প্রতিবাদ করে কাজ হচ্ছে না । যা ইচ্ছে তাই মানে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছেন সে দলের নেতারা ।ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট নরেন্দ্র মোদী আর তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি অমিত শাহ মশায়কে দমায় সাধ্যি কার ! অথচ কোন বিরোধী দল এককভাবে এাঁদের মোকাবিলা করতে অক্ষম ।
তাই জোট । অথবা ঘোঁট । মনে পড়ে, প্রথম যখন জোট সরকার গঠিত হয়েছিল এদেশে , তখন সিপিএম বলেছিল , এককভাবে কোন দলের সরকার গঠনের দিন শেষ ।কিন্তু দেখা গেল মোরারজি দেশাই থেকে শুরু করে পর পর যে কটি জোট সরকার তৈরি হল ,মাসকয়েকের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তাদের শ্বাসকষ্ট । তবে জোট সরকার যে একেবারে ব্যর্থ , তা বলা যাবে না । অটলবিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিংয়ের জোট সরকার টিকে গিয়েছিল । অবশ্য মনমোহনকে সিপিএমের লেংগি খেতে হয়েছিল । জোট সরকারের একটি শরিকের কোমরের জোর দরকার । সেটাই টিকে থাকার শর্ত । নিন্দুকেরাও স্বীকার করবেন , জোট সরকার টিকিয়ে রাখার শক্তি ছিল জ্যোতি বসুর । কিন্তু তাঁর দলের নেতারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের ব্যাপারে ওস্তাদ ।কংগ্রেস জাতীয় দল । কয়েকটি দশক ধরে সে দলের রক্তক্ষরণ চলছে চলবে । লোকসভা ও বিধানসভার ভোটে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে দল । সমস্যাটা কর্মীদের নয় । নেতৃত্বের । সোনিয়া গাঁধী জোড়াতাপ্পি দিয়ে রেখেছিলেন । তারপরে রাহুল এলেন । বার বার দিকভুল করতে লাগলেন । তিনি সে দলে আছেন , আবার নেই । এই আছে এই নেই আছে / দূরে কাছে ঘুরে নাচে । মাঝে মাঝে তাঁর বক্রোক্তি আর বজ্রগর্জন শোনা যায় । তারপরে অখন্ড নীরবতা । ধারাবাহিকতা না থাকলে কথা শুনবে কেন কর্মীরা ! তার উপর গাঁধী পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যের ব্যাপারে ক্ষোভ ।
এই ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে প্রশ্ন । সে প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জী । বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তাঁকে সে সুযোগ দিয়েছে । দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমের প্রচার সে সুযোগকে পাল্লায় ভারি করতে সাহায্য করেছে । তারপরে তাঁর দল আর একটা প্রশ্ন তুলে ধরল : দেশে মোদী-বিরোধী মুখ কে ? সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে মমতার মতো মোদী-বিরোধী প্রতিবাদ আর কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন সোচ্চারভাবে করেন নি । দলের শক্তি বাড়ানোর জন্য মমতার দল ত্রিপুরা, গোয়া , অসম , মেঘালয়ে যাতায়াত শুরু করল । শরদ পওয়ারকে সামনে রেখে জোটের একটা মহড়া শুরু করল ।
আর এই দেখে কংগ্রেস তো রাগে তা তা থই থই । কি, জাতীয় দল কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট ? মন শুধু বলে অসম্ভব , এ অসম্ভব । তৃণমূলের থলিতে যুক্তি ছিল । তাদের নেতারা বলতে লাগলেন , যে রাজ্যে কংগ্রেস শক্তিশালী, সে রাজ্যে তো তাঁরা বাগড়া দিতে যাচ্ছেন না । এই যুক্তিটায় জোর আছে । যে রাজ্যে যার শক্তি আছে, তাকে অগ্রাধিকার দিলে , মসৃণ হতে পারে জোট । তখন আর ঘোঁটের খুব বেশি ভয় থাকবে না ।তবে , বিরোধীরা শুধু একা খেলবেন না । বিজেপিও নেমে পড়বে খেলার মাঠে । চেষ্টা করবে জোটের ভেতর বেনোজল ঢুকিয়ে দিতে । জোটের শরিকদের অন্তর্ঘাতের ইন্ধন জোগাবে ক্রমাগত । কাঞ্চনরঙ্গ শুরু হয়ে যাবে , লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন । কারণ বিজেপির মতো ধনী দল ভূ-ভারতে আর নেই ।আর একটু অপেক্ষা করুন । জমজমাট খেলা শুরু হয়ে যাবে । খেলতে খেলতে নেতারা দেদার প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে যাবেন । প্রগতির বান ডাকবে দেশে । পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করবে । বন্ধ্যা জননীর সন্তান হবে । অপুষ্টিজর্জর শিশুর মুখে ফুটবে কোলগেটের হাসি । হবে হবে ,সব হবে । আর জনগণেশ প্রতিশ্রুতির রস পান করে টিকে থাকবে ।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।