মুজিব প্রটোকল: জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে লিভার বিশেষজ্ঞদের শ্রদ্ধার্ঘ্য

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাও তিনি। আজকে বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের যে স্বাধীন উপস্থিতি তার শতভাগ কৃতিত্ব তার – হয়তো আরো একটু বেশি, কিন্তু কম নয় তার চেয়ে এতটুকুও। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি না কেন তার সবটুকুই তার জন্য। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ জাতি এই করোনাকালেও যার যার জায়গা থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।

এটি সত্যি বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশের যা কিছু হয়েছে তার কোন কিছুই হতো না। কিন্তু তারপরও এই কথাগুলো এদেশের লিভার বিষেশজ্ঞদের জন্য আরেকটু বেশি করে প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই’ স্থাপিত হয়েছিল দেশের প্রথম লিভার বিভাগটি। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম লিভার বিভাগ। প্রথমটি স্থাপিত হয়েছিল ভারতের চন্ডীগড় পোস্টগ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউটে। এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগেই একদিন চালু হয়েছিল এই উপমহাদেশে লিভার বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রথম পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স – ‘ডক্তর অব মেডিসিন (এমডি) ইন হেপাটোলেজি’। আজ দেশে যে শতাধিক লিভার বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের নব্বই শতাংশের সার্টিফিকেটই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে স্বতন্ত্র লিভার বিভাগগুলোর যাত্রা শুরু।

এই প্রেক্ষাপটে মুজিব বর্ষে বাংলাদেশে লিভার বিশেষজ্ঞদের অন্তরের আকুতি ছিল এমন কিছু একটা করা যা জাতির পিতার জন্মজয়ন্তীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। জাতির পিতা তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এদেশের মানুষের কল্যাণে। তার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদাকে চেয়ারম্যান করে গঠন করেছিলেন শিক্ষা কমিশন। সেই প্রেক্ষাপটে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের নিবেদন ‘মুজিব প্রটোকল’।

লিভারের একটি কঠিন রোগের নাম একিউট অন ক্রনিক লিভার ফেইলিওর, সংক্ষেপে ‘এসিএলএফ’। এটি এমন একটি রোগ যেখানে আগে থেকে লিভার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার সহসাই ফেইল করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আগে থেকে হয়তো রোগীর জানাই ছিল না যে তিনি ক্রনিক লিভার ডিজিজের রোগী। তিনি স্বাভাবিকভাবেই দিব্যি চলাফেরা করছেন অথচ হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ফেইল করে বসল হতভাগা লিভার, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এসিএলএফ’র কারণ অনেক, সেটি অন্য আলোচনায় বিষয়। তবে এই রোগের পরিণতি খুবই করুন। দেখা গেছে ৩০-৭০% এসিএলএফ রোগী শেষমেষ আর সুস্থ হয়ে ওঠেন না। আমরা তাদের হারিয়ে ফেলি। এটি শুধু বাংলাদেশের বেলাতেই নয় বরং পুরো এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আর এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার বেলাতেও প্রযোজ্য।

এসিএলএফ’র ধ্বনন্তরী চিকিৎসাটি হলো লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। এটি যে শুধু টেকনিক্যালই চ্যালেঞ্জিং তাই নয়, ব্যয়বহুলও বটে। সাথে আছে ডোনার পাওয়ার সংকট। ভারতের মতো দেশ, যারা পৃথিবীতে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনে শীর্ষস্থানে, তারাও তাদের জাতীয় চাহিদার অর্ধেক লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনও এখন পর্যন্ত করতে পারে না। এ কথাটি প্রযোজ্য পৃথিবীর তাবৎ বড়-বড় লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টিং নেশনের জন্যই। আর বিশেষ করে এসিএলএফ’র রোগীরা খুবই অসুস্থ থাকেন বলে তাদের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনও করতে হয় খুবই তাড়াতাড়ি। এতে যুক্ত হয় বাড়তি খরচ আর ঝুকি।

এই প্রেক্ষাপটে এসিএলএফ’র রোগীদের চিকিৎসায় সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম কার্যকর বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিটি হচ্ছে প্লাজমা এক্সচেঞ্জ, সংক্ষেপে ‘প্লেক্স’। আমাদের এই অঞ্চলে এসিএলএফ চিকিৎসায় প্লেক্স ব্যবহারে সবচাইতে বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে ভারতের ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। মুজিব বর্ষের শুরুতেই আমরা তাদের সাথে বৈজ্ঞানিক কোলাবরেশন শুরু করি। এ বছরের জানুয়ারিতে ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিভার বিভাগে অনুষ্ঠিত হয় ‘মুজিব লেকচার’। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওখানকার লিভার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেমাটোলজি, নেফ্রোলজি, রেডিওলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও রেসিডেন্টদের সামনে ‘মুজিব লেকচার’ প্রদান করে তাদের সামনে লিভার সিরোসিস চিকিৎসায় অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনে আমাদের অভিজ্ঞতা উপস্থাপনের। এ সময় তাদের প্লেক্স কার্যক্রম হাতে-কলমে দেখার আর তাদের সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত মতবিনিময়ের সুযোগ আমাদের হয়েছিল। করোনাকালে দেশে প্লেক্স শুরু করায় আমরা শুরুতে একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা আমাদের লক্ষ্যে স্থির ছিলাম। মুজিব বর্ষেই আমরা এদেশে প্লেক্স আরম্ভ করতে পেরেছি এবং আমাদের প্রাথমিক তথ্য উপাত্ত খুবই আশাজাগানিয়া।

এসিএলএফ’এ কোভিডের মতোই অ্যাকিউট ইনফ্ল্যামেটরি ক্যাসকেড অ্যাক্টিভেশন হয়। ফলে রক্তে ভন উইলিব্রান্ড ফ্যাক্টরের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে রক্তের অনুচক্রিকা বা প্ল্যাটিলেটগুলো জমাট বেধে সুক্ষাতিসুক্ষ রক্তনালীগুলোতে রক্ত সঞ্চালনে বাধা দেয়। এ থেকে দেখা দেয় মাল্টি-অর্গান ফেইলিওর। রক্তে এডামটিএস-১৩ নামক এক ধরনের মেটালোপ্রোটিনেজ আছে যা এই ভন উইলিব্রান্ড ফ্যাক্টরগুলোকে রক্ত থেকে সরিয়ে ফেলে। প্লেক্সের মাধ্যমে এসিএলএফ রোগীর শরীরে এডামটিএস-১৩ সরবরাহ করা হয়, যার ফলে রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়। সাধারণত রোগীকে পরপর তিন দিন, তিন সেশন প্লেক্স করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম এই বাঙালি মহানায়ককে শ্রদ্ধা জানাতে আমরা এ দেশে শুরু করেছি ‘প্লেক্স’ আর তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই চিকিৎসা পদ্ধতির এদেশে নামকরণ করেছি ‘মুজিব প্রটোকল’। ‘মুজিব প্রটোকলে’ আমাদের প্রাথমিক যে অভিজ্ঞতা তা আমরা সম্প্রতি প্রকাশ করেছি ‘Acta Scientific Gastrointestinal Disorders’ নামের একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে। জাতির পিতা এ জাতির জন্য যা করে গেছেন তার ঋন আমরা সহস্র চেষ্টায়ও কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তারপরও জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে তার স্মরণে, শ্রদ্ধায় এদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের বিনীত নিবেদন এই ‘মুজিব প্রটোকল’।

মামুন আল মাহতাববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

You might also like