মোদীর হাগপ্লোমেসি বা জাপ্টা-জাপ্টির কূটনীতি

 দিলীপ মজুমদার

বাংলা ব্যাকরণে ‘সন্ধি’ বলে একটা ব্যাপার আছে ।সেখানে বর্ণের মিলন হয় । দুটো আলাদা শব্দ একটা নতুন শব্দে পরিণত হয় ।সাধারণ মানুষ সন্ধির নিয়ম না জেনেও কিন্তু দুটো শব্দকে এক শব্দে পরিণত করে নেয় তাদের উচ্চারণের সুবিধার জন্য ।যেমন জামানত + বাজেয়াপ্ত = জামানাপ্ত । এই যেমন এবারের উপনির্বাচনে তিনটি কেন্দ্রে বিজেপির জামানাপ্ত হয়েছে । তেমনি দুই শব্দের মিলনে তৈরি হয়েছে ‘ হাগপ্লোমেসি’।দুটোই ইংরেজি শব্দ।hug + diplomacy = hugplomacy . ‘hag’ শব্দের বাংলা অর্থ হল আলিঙ্গন ।আলিঙ্গন’ সংস্কৃতগন্ধী শব্দ । বাংলায় জাপ্টা-জাপ্টি বা জড়াজড়ি বললে ঠিক ভাবটি বোঝায়।আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাপ্টা-জাপ্টির কূটনীতির কথায় এবার যাওয়া যাক ।প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নানা বিষয়ে অভিনবত্বের পথিকৃৎ । যেমন ধরুন , কালোটাকার গুষ্টি-তুষ্টি করা , কোন প্রস্তুতি ছাড়া জিএসটি প্রবর্তন করা , শুধু বিশ্বাসের ভিত্তিতে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা , কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করা , থালা বাজিয়ে ও মোমবাতি জ্বেলে করোনার হৃদপিণ্ড ফাটিয়ে দেওয়া এবং তারপরে ১০০ কোটি টিকা দিয়ে সেই ফাটা হৃদপিণ্ডকে চৌচির করে দেওয়া ,পোশাকে –আশাকে নিত্য-নতুন স্টাইল প্রবর্তন করা ইত্যাদি ইত্যাদি । বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে তাঁর আলিঙ্গন বা জাপ্টা-জাপ্টি তেমনি এক অভিনব ব্যাপার ।

বিদেশি সংবাদপত্রেও তার চর্চা চলে । মোদীর জীবনী-লেখিকা নীলাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় তাঁর Narendra Modi : The Man, The Times ( 2013 ) বইতে এই জাপ্টা-জাপ্টির চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তিনি বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর দ্বারা একটা বার্তা দিতে চান । কি সেই বার্তা ? বার্তাটা হল তিনি যাঁদের সঙ্গে জাপ্টা-জাপ্টি করেন ,তাঁদের সমান তিনি , তিনি তাঁদের বন্ধু । আসলে নরেন্দ্র মোদীবাবু অন্তরের গভীরে রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সব ঠাঁই তাঁর ঘর আছে , দেশে দেশে আছে পরমাত্মীয় । কিন্তু মোদীবাবুর পরকে আপন করার এই অভিপ্রায় বুঝতে পারেন নি গুতেরেস । জি-২০ গোষ্ঠীর বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন মোদীবাবু । ভাটিকানে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গেও জাপ্টা-জা[প্টি করে এসেছেন তিনি । ভারতে আসার নেমতন্ন করে এসেছেন । কিন্তু গ্লাসগোয় জলবায়ু সম্মেলনের মঞ্চে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেসকে বিয়ার-হাগ করতে যেতে তিনি অস্বস্তি প্রকাশ করলেন । একেই বলে স্বর্গীয় মূর্খতা । তিনি মোদীবাবুর আন্তরিকতা দেখলেন না , দেখলেন না তাঁর বুকের ভেতরের উষ্ণতা । কি এমন ক্ষতি হত, একবার জাপ্টা-জাপ্টির সুযোগ দিলে !

এ তো হঠাৎ কিছু নয় । মোদীবাবুর এই রীতির সঙ্গে বিশ্বনেতারা সুপরিচিত । শুধু তো তাঁর প্রাণের বন্ধু ডোনাল্ড ট্র্যাম্প নয় , তাঁর আগের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে জাপ্টে ধরতে মোদীবাবু বিমান বন্দরে হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং । ট্র্যাম্পের পরের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও তিনি জাপ্টে ধরেছিলেন পরম আদরে । ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরার সে দৃশ্য সৃষ্টি করেছিল রোমাঞ্চ । যাকে বলে টাইটানিক হাগ । রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু , আফগান প্রেসিডেন্ট আশর্ফ গনি, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো , সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমন সকলেই মোদীবাবুর জাপ্টা-জাপ্টির স্বাদ পেয়েছেন ।তবে হ্যাঁ, মোদীবাবু মোট ৭১ জন বিশ্বনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও তাঁদের সবাইকে জাপ্টে ধরেন নি । জাপ্টে ধরেছেন মোট ২১ জন বিশ্বনেতাকে।এঁদের মধ্যে কারোকে একাধিকবার জাপ্টানি সহ্য করতে হয়েছে । নিন্দুকেরা বলেন ,যে সব দেশের জিডিপি বেশি, তাদের নেতাদেরই তিনি জাপ্টেছেন ।আরও একটা কথা,যেহেতু তিনি মূলত আর এস এস-র প্রচারক তাই নারীদের জাপ্টে ধরেন নি । যেমন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তাঁদের জাপ্টে ধরলে কেলেঙ্কারি হত বৈকি । সপাট চপেটাঘাতও জুটতে পারত ।

মোদীবাবুর এই জাপ্টা-জাপ্টি নিয়ে কংগ্রেস দল বিদ্রূপের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল । প্রকাশ করেছিল একটা ভিডিয়ো । নিন্দুক আর কাকে বলে ! কাজ নাই তো খই ভাজ—তাদের । কিন্তু এই বিদ্রূপের যে বিনম্র জবাব দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী , তা লা জবাব । তিনি বলেছেন , ‘ আমি অত্যন্ত সাধারণ এক মানুষ । প্রোটোকল কি সেটা জানি না ।আমার সরলতাই আমার বড় শক্তি । এই সরলতা দিয়ে রাষ্ট্রনেতাদের আপন করে নেবার চেষ্টা করি আমি ।আমার যদি ট্রেনিং নেওয়া থাকত তাহলে আমিও আদব-কায়দা, রীতি-নীতি মেনে রাষ্ট্রনেতাদের স্বাগত জানাতাম । তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় ডানদিক বামদিক দেখে নিতাম ।এমন সরল, এমন নিষ্পাপ স্বীকারোক্তিতে জব্দ কংগ্রেস । তাছাড়া কংগ্রেস এ কথা বলেও বা কি করে ! মনে নেই ২০১৮ সালের কথা ! সংসদের মধ্যে তাদের নেতা রাহুল গাঁধী জড়িয়ে ধরেছিলেন মোদীবাবুকে । শুধু জড়িয়ে ধরা নয় , চোখও মেরেছিলেন । তবে !

লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

You might also like