রবীন্দ্রনাথ জড়ালেন পাঁচিল ভাঙার রাজনীতিতে

 দিলীপ মজুমদার

বড় মানুষদের সৌভাগ্য যেমন,তেমনি দুর্ভাগ্য তাঁদের।মৃত্যুর পরেও তাঁদের নিয়ে কাটা-ছেঁড়া চলে।সমালোচনা,গালাগালি তো আছেই।তাঁদের বাণী উদ্ধৃত করা হয় নিজের নিজের স্বার্থে।রবীন্দ্রনাথ সেইরকম এক দুর্ভাগা মানুষ।তিনি প্রগতিশীল,না প্রতিক্রিয়াশীল,সে বিতর্ক এখনও চলছে।তাঁর গোপন প্রেমের রহস্য সন্ধান চলছে চলবে।কোন সমস্যা সৃয্টি হলে,নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলের নেতারা তাঁকে শিখণ্ডি খাড়া করে,তাঁর বক্তব্যের অংশবিশেয উদ্ধৃত করে বাজিমাৎ করতে চায়।এবার পৌযমেলার মাঠে পাঁচিল তোলা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক কাজিয়া।

পৌযমেলা শান্তিনিকেতনের বিশেষ ঐতিহ্য।সে মেলার বয়স হল ১২৯ বৎসর।১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌয ( ২১ ডিসেম্বর,১৮৪৩) দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর ২০ জন অনুগামী রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেন।এটাই পৌযমেলার ভিত্তি।তবে মেলা শুরু হয় তার অনেক পরে।১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৭ পৌয শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হয় এক ব্রাহ্মমন্দির।সেই উপলক্ষে উল্টোদিকের মাঠে একটি ছোট মেলার আয়োজন করা হয়েছিল । সেই থেকে পৌযমেলার শুরু।এ বছর জুন মাসে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা আর পৌষমেলার আয়োজন করবেন না।কেন করবেন না তার সঠিক কারণ জানা গেল না।দূষণ ? সে সমস্যা তো সারা দেশের।কলকাতা বইমেলার ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন উঠেছিল।তারও একটা সমাধান হয়েছে।তাহলে পৌযমেলার ক্ষেত্রে তা হবে না কেন ? আপত্তি উঠল।আশ্রমিকরা, প্রাক্তনীরা,অমর্ত্য সেনের মতো মানুযেরা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন।তখনও এর মধ্যে রাজনীতির ঘোলাজল ঢোকে নি।কিন্তু অনড় বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ।বর্তমান উপাচার্যের নীতি ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ।

এখানেই তিনি থেমে থাকলেন না।এ বছর অগস্ট মাসে পৌযমেলা চত্বরকে দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেবার কাজ শুরু হল।এ কাজের জন্য ব্যয় বরাদ্দ হল ৬১ লক্ষ টাকা।উপাচার্যসহ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রভক্ত।তাঁরা অচলায়তনের মধ্যে রবীন্দ্র ঐতিহ্য রক্ষা করতে চান।তাই চারদিকে পাঁচিল দিতে হয় যত্ন করে।পাঁচিল দেওয়ার পরে তাকে ভাঙার উদ্যোগ নিলেন আর এক দল রবীন্দ্রভক্ত।এঁদের মধ্যে শাসক দলের লোকজন ছিলেন বলে সংবাদে প্রকাশ । হবে না-ই বা কেন !শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রী যে পরম রবীন্দ্রভক্ত।কথায় কথায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলেন, রবীন্দ্রনাথের গানে গলা মেলান।তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর কর্মী- সমর্থকরা পাঁচিল ভেঙে ফেললেন।আর যেই পাঁচিল ভাঙা হল,অমনি উদয় হলেন আর এক দলের রবীন্দ্রভক্ত।শাসক দলকে তুলোধোনা করে তাঁরা বললেন রবীন্দ্র-ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য পাঁচিল দরকার।গেরুয়া-রঙিন এই দলের এক মুখপাত্র তেজস্বী কণ্ঠে জানালেন পৌযমেলার মাঠে সেক্স র‍্যাকেটের কথা।এসব ঘটনার কিছু পরে এই দলের প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্র আদর্শের কথা বললেন গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে।বাকি থাকলেন রক্তিমবর্ণধারী বামেরা।তাঁরা না-তৃণমূল,না- বিজেপি।তাঁরা আগের ভুল সংশোধন করে নতুন করে রবীন্দ্রভক্ত হয়েছেন।বামেরা পাঁচিল করা এবং পাঁচিল ভাঙা দুটোকেই তীব্রভাষায় সমালোচনা করলেন।আগের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিদ্যাসাগর মশায়ের মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে আলোড়ন হয়েছিল,এবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে বলির পাঁঠা রবীন্দ্রনাথ।বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ কেউ নন,আসল ব্যাপারটা ভোট ।নিজেকে বাঙালি ভোটারের কাছে রবীন্দ্রভক্ত প্রমাণ করাটা একটা অ্যাডভান্টেজ।যেমন রামভক্তির অ্যাডভান্টেজ আছে।রবীন্দ্রনাথ মরে বেঁচেছেন।বেঁচে থাকলে তাঁকে লজ্জায় মরে যেতে হত । মরার আগে সুইসাইড নোটে হয়তো লিখে যেতেন,আমি বলিয়াছিলাম না,পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া বাঙালির পলিটিক্স।

You might also like