রবীন্দ্রনাথ বললেন
দিলীপ মজুমদার
আমার জন্মের অনেক আগে মৃত্যুবরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।তাই তাঁকে দেখা বা তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়।তবু জগতে নানা অঘটন ঘটে।সেই রকম একটা অঘটনের কথা আজ খুব সতর্ক হয়ে আপনাদের জানাতে চাই।একটা চিঠি পৌঁছে দেবার জন্য ওই দিন বিকেলে আমাকে যেতে হয় জোড়াসাঁকোয় । রবীন্দ্র ভারতীতে।রবীন্দ্র ভারতী সোসাইটির একতলায় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন রুদ্রনীলবাবু । তাঁর সঙ্গে দেখা করে চিঠি দিয়ে আমি সামনের লনে বসলাম।সামনেই রবীন্দ্রনাথের বিরাট মূর্তি।করোনার জন্য আগের মতো হামলে পড়া ভিড় নেই ।একটু জিরিয়ে নিয়ে চলে যাব।হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।আমার আশপাশে তো কেই নেই।কে কথা বলল? রবীন্দ্রনাথের মূর্তির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।দেখলাম মূর্তির মুখ নড়ছে ।অবাক কাণ্ড । এ যেন অস্কার ওয়াইল্ডের ‘হ্যাপি প্রিন্স’এর কথা বলা মূর্তির মতো।রবীন্দ্রনাথ গুরু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন , তুমি কি টেগোরিয়ান ?
বুঝতে না পেরে তাঁর দকে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি জানতে চাইলেন আমি রবীন্দ্রভক্ত কি না । আমার মনে হল তিনি ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেন । রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রভক্তকে ভয় করেন ? এ তো অদ্ভুত ব্যাপার । তিনি বলেন , হ্যাঁ , ভয় করে । কার্ল মার্কস শেষের দিকে একটা কথা বলতেন । বলতেন , বি অ্যাওয়ার অফ মার্কসিস্ট । শুনেছ ?
কার্ল মার্কস ! রবীন্দ্রনাথের মুখে কার্ল মার্কসের কথা !
আমি বলি , নাঃ । আপনি কি কার্ল মার্কসের কথা জানেন ? আপনার লেখায় তো তাঁর নাম পাই নি ।
–রাশিয়ায় গিয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম । রাশিয়া ছেড়ে তিনি লণ্ডনে আস্তানা গেড়েছিলেন জীবনের শেষ তিন দশক । এবার বলো তুমি রবীন্দ্রভক্ত কি না ?
–না , তেমন ভক্ত-টক্ত নই । তবে আপনার লেখা-টেখা পড়ি ।
–যাক বাবা বাঁচালে । রবীন্দ্রভক্তরা সাংঘাতিক জিনিস । আমার লেখা তাদের পড়ার দরকার নেই । বিশেষ করে প্রবন্ধ । আমার উপন্যাস, নাটক এ সবও খুব একটা কেউ পড়ে না । আমার লেখা না পড়ে , আমাকে না চিনেই তারা রবীন্দ্র ভক্ত । সাংঘাতিক না ?
–কেন , আপনার কবিতা তো বহু লোক আবৃত্তি করে , আপনার গানের বাজারও রমরমা , কত ক্যাসেট , কত সিডি , কত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী , আপনার রচনাবলিরও বাজারও ভালো । তাছাড়া আপনাকে নিয়ে কত বই লেখা হয়েছে ও হচ্ছে । গবেষণা হচ্ছে , সেমিনার হচ্ছে, এমন কি রাজনৈতিক নেতারাও ভাষণে আনছেন আপনার কথা ।আমার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন । আমি অবাক । হাসির কথা কিছু তো বলি নি । বুঝতে পেরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি একটা সমীক্ষা করো । দেখবে মাত্র শ’ দেড়েক কবিতাই ঘুরে- ফিরে আবৃত্তি করে লোকে , মাত্র শ’ দুয়েক গান ঘুরতে থাকে । আর রচনাবলির কথা বলছ ? ওগুলো ড্রইংরুমের শোভা বর্ধন করার জন্য । জমবে ধুলো তানপুরাটার তারগুলায়—আর কি । আমাকে নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতরণী পার হবার জন্যই সেগুলো কাজে লাগে । তবে হ্যাঁ , আমার নানা মুখোরোচক খবর বা কেচ্ছা নিয়ে লেখা বইগুলির বিক্রি ভালো । তার কোন কোনটা আবার বেস্ট সেলার হয়ে যায় ।রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বার্থসিদ্ধ করার জন্য আমাকে ব্যবহার করে ।আমার লেখা থেকে ভুল-ভাল উদ্ধৃতি দেয় ।
-কেচ্ছার কথা বললেন কেন ? ? আপনি কি আপনার নতুন বউঠানের কথা বলছেন ?
দেখলাম রবীন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে গেলেন । এ প্রসঙ্গ বাদ দিতে বললেন । কিন্তু তখন আমার জেদ চেপেছে । আমি বললাম, কেচ্ছায় আমার কোন উৎসাহ নেই ,ওসব আমি পড়ি না বটতলার বোঁটকা গন্ধ পাই বলে । তবে আমি বলব আপনি নতুন বৌঠানের প্রতি কর্তব্য পালন করেন নি ।
–মানে ?
-হতভাগ্য সেই নারী যখন তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন , তখন আপনি নীরব নিশ্চুপ । কেন, বাবার ভয়ে ? মাসোহারা বন্ধ হবার ভয়ে ? অথচ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখছেন তাঁর কথা । গানে , কবিতায় । ঝরে পড়ছে বেদনা । তার গভীরতা অনুভব করতে পারি । কিন্তু কোন প্রতিবিধানে এগিয়ে আসেন নি কেন ? শুধু কি তাই , তাঁর মৃত্যুর দিন কতক পরে আপনি সরোজিনী জাহাজে চেপে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন । বলুন তো, কেন এই দ্বিচারিতা ?
চুপ করে থাকেন রবীন্দ্রনাথ । একটু পরে বলেন, উত্তরসূরীর এই সমালোচনা মাথায় তুলে নিচ্ছি ।
আমি তখন সাহস পেয়েছি । আমার প্রিয় এই মানুষটির দ্বিচারিতা আমাকে পীড়া দেয় । আমি তার কারণ জানতে চাই । বলি , আপনি আপনার ঠাকরদাকে বা এমন উপেক্ষা করেছেন কেন ? আপনার বিশাল রচনাবলিতে দ্বারকানাথকে নিয়ে একটা লেখাও নেই । কেন ? এখানেও কি আপনার বাবার ছায়া ? না, ঠাকুরমার ছায়া ? ওঁরা দুজনেই তো সংস্কারগ্রস্ত মানুষ , সংকীর্ণমনা । অথচ আপনার ঠাকুরদা রামমোহনের মতো বিশ্বপথিক । আপনার মানসিকতার সঙ্গে মিলটা আপনার ঠাকুরদারই, বাবার নয় । যে অর্থনীতি সমাজের বুনিয়াদ , আপনার ঠাকুরদা তাকেই সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন । বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে সাহেবসুবোর সঙ্গে মেলামেশা করা , আফিম ব্যবসা করা এত কি অপরাধ , যার জন্য তাঁকে আজীবন বর্জন করলেন ? এতবার লণ্ডনে গেলেন , একবার তাঁর সমাধি দেখে এলেন না ?
রবীন্দ্রনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন , থামো , থামো । বুঝতে পেরেছি তুমি তেমন রবীন্দ্র ভক্ত নও , যাকে আমি ভয় পাই । কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে ।
ঠিক এমনি সময়ে সংগীত ভবনের দিক থেকে একটা কর্কশকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল—‘কে, কে ওখানে ?’
সে কণ্ঠস্বর শুনে রবীন্দ্রনাথ ভয় পেয়ে গেলেন । বললেন , আর নয় । তুমি উঠে পড়ো , আমিও গুটিয়ে যাচ্ছি ।
–কিন্তু উনি কে ? ওঁকে আপনার এত ভয় কেন ?
– উনি এখানকার কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা।প্রচণ্ড রবীন্দ্র ভক্ত । তাই রবীন্দ্রনাথের গোটা পাঁচেক কবিতা ছাড়া ওঁকে আর কিছু পড়তে হয় নি।অথচ উনি রবীন্দ্রনাথকে গুলে খেয়েছেন।রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঝাড়া এক ঘন্টা উনি ভাষণ দিতে পারেন । প্রচুর হাততালি পড়ে।আসছে,এদিকেই আসছে।যাও যাও ,সোজা বাড়ি চলে যাও ।আমি উঠে পড়েছি । মূর্তির মধ্যে ঢুকে যাবার আগে রবীন্দ্রনাথ কম্পিত স্বরে বললেন ,এ যুগে রাজনৈতিক নেতারাই সবচেয়ে শক্তিশালী।তাঁদের আদেশে সাদা কালো হয় ,কালো সাদা হয় ; সত্য মিথ্যা হয় ,মিথ্যা সত্য হয়।যে কোন মনীষীকে তুড়ি মেরে উঠিয়ে দেবার দুর্দমনীয় ক্ষমতা তাঁদের আছে । আমি তো কোন ছার ।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।