শাহ ফারুক আহমদের কাব্যগ্রন্থ ‘অন্তরা’ এবং নিবন্ধগ্রন্থ ‘চিন্তার কথা ভাবনার কথা’ নিয়ে একটি আলোচনা
হামিদ মোহাম্মদ
লেখক ফারুক আহমদ একজন প্রতিবাদী ও মানবিক মানুষ। তার সাথে পরিচয় অনেক আগের। তবে ঘনিষ্টতা বেশি দিনের নয়। তিনি একটি বিশাল রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বড়ভাই শাহ মোদাব্বির আলী একজন সংগ্রামী বিদগ্ধজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনীতিক। শাহ শামীম আহমদ তাদের পরিবারের আরেক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, কবি ও রাজনীতিক। তারা সকলেই প্রতিবাদী ও মানবিক মানুষ। এই ঐতিহ্যের পতাকাবাহী শাহ ফারুক আহমদ। বাংলাদেশে ছাত্রজীবন সমাপ্ত করেন আইনশাস্ত্রে পাড়শোনা করে। পরে বিলেত চলে আসেন। বিলেত এলেও তার মনোযোগ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বিলেতের বাংলাদেশী কমিউনিটির অবস্থান মজবুত করার লড়াইয়ে একজন প্রতিবাদী যোদ্ধা হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বৃদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক ন্যায়বান মানুষ শাহ ফারুক আহমদ লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন তার স্বভাবসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। কল্যাণমূলক কাজে কলমসৈনিক হিসেবে বিলেতের পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মিডিয়াতে সোচ্চার তার জীবন সকলের দৃষ্টি কাড়ে।
সমাজের একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও করেন পূর্ব লন্ডনের একটি প্রাইমারি স্কুলে। চাকরি হিসেবে যতটুকু ভাবনা,তার চেয়ে দায়িত্ব হিসেবে কাজ করেছেন কমিউনটির সন্তানদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। নিজের সন্তানের মত ভালবাসা ছিল প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি।
তার একটি কবিতার গ্রন্থ ‘অন্তরা’ এবং নিবন্ধ গ্রন্থ ‘চিন্তার কথা ভাবনার কথা’ পড়ে আমার মনে হয়েছে শিক্ষকতার ভালবাসাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে লেখালেখির জগতে প্রবেশের। তিনি হয়ত বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি, কিন্তু নিজের চিন্তার প্রতিফলন সমাজে রেখে যাওয়ার স্পৃহা ছিল অতুলনীয়।
এই মনোভাব প্রকাশ করার তৃঞ্চা গ্রন্থগুলো পড়লেই অনুধাবন করা সহজ হয়ে পড়ে।গ্রন্থসমূহের আলোচনায় যাওয়ার আগে শাহ ফারুক আহমদ লেখালেখির জগতে নিজেকে যেভাবে যুক্ত করেছেন, যে দায়বোধ তার প্রতি ছত্রে বা স্তবকে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে এর জন্য প্রথমে অভিনন্দন, লেখক হিসেবে নিজেকে সমাজের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত করার আকাক্সক্ষার জন্য স্বাগত জানাই।
প্রথমেই বলতে হয়, গ্রন্থগুলো নিয়ে আমার পাঠ ও মতামত খুব জরুরী নয়। জরুরী কাজ হল এভাবে যদি আমাদের সমাজের জ্ঞানী ও গুণীজনরা তাদের চিন্তার ও জ্ঞানের কথাগুলো সকলেই জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ করে যেতেন, তবে আমাদের প্রজন্ম এবং পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হতেন, সমাজ উপকৃত হত। শাহ ফারুক আহমদের উপরোক্ত গ্রন্থগুলো সেই অর্থে আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। আমি তাকে গ্রন্থগুলো প্রকাশের সাহসিকতার জন্য আবারও সাধুবাদ জানাই। সাহসিকতা বললাম এজন্য যে, সাহস করে অনেকে তার মনের বাসনার কথা লিপিবদ্ধ করেন না, তিনি সাহস করেছেন। মূলত তার স্বপ্নঘেরা কথাগুলো প্রকাশ করে আমাদের সমৃদ্ধই করেছেন, সমাজ উপকৃত হয়েছে।
বইগুলো সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা দায়িত্ববোধ করছি। প্রথমে আলোচনা করবো কবিতাগ্রন্থ ‘অন্তরা’ নিয়ে। আমরা যারা লেখালেখি করি তারা সকলেই কবিতা সম্পর্কে কবি জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত মন্তব্যটি জানি। জীবননান্দ দাশের এই অনবদ্য উক্তি তরুণ কবিদের তো এক রকম মনের কথা হিসেবে চর্চিত। তিনি বলেছেন,–‘সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। তবে মজার কথা হল, জীবননান্দ দাশের এই উক্তির শিকার তিনি নিজে। স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ কবি জীবননান্দ দাশের কবিতা পড়ে হাসি-টাট্টা করেছেন, তিরস্কারও করেছেন। নিজের জীবদ্দশায়জীবননান্দ দাশ সমসাময়িক কবিদের স্বীকৃতিই পাননি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যত দিন যাচ্ছে, তত তিনি নমস্য ও সৃজনশীল আধুনিক কবি হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কবিতার সংজ্ঞা কি এবং কবিতার ছন্দ ও কলকব্জা নিয়ে কথা বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণা ও জ্ঞান মতে, যার মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, এবং পাঠক উদ্বুদ্ধ হন, তা-ই কবিতা। এর চেয়ে বেশি বলার অবকাশ নেই, প্রয়োজনও মনে করছি না।
‘অন্তরা’ নাম কবিতার গ্রন্থ, এটাই তো একটি কবিতা। আমরা সকলেই হয়ত মরমী কবি দুর্বিন শাহর একটি গানের ছত্র জানি–‘আমার অন্তরায় আমার কলিজায়, প্রেমসেল বিন্দিল গো’। এ যে ‘অন্তরা’ কথাটি তা তো আমাদের ‘হৃদয়’ নামক জটিল কোটরের নাম। যেখানে জীবনের সকল বেদনা আনন্দ প্রেম লুকায়িত। গোপন নিবাস জীবনের সকল আর্তির। এই মর্মভেদী উচ্চারণ একজন কবি ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। শাহ ফারুক আহমদ কবিতাগ্রন্থের ‘অন্তরা’ নামের সৃজন কৌশলের জন্যই কবির মর্যাদায় আসীন বলে আমি আরেকবার অভিনন্দন জানাই। কবির এই ‘অন্তরা’ কবির ‘মানসী’। ২৩টি কবিতা এই মানসীকে নিয়ে। সাদাসিধে কথায় মনে হবে তার প্রিয়তমার কথাই। এখানে প্রকৃতি, জীবনছোঁয়া নানান রঙ, প্রাণ আকুলকরা কেউ। এই আকুলকরা মানসী কখনো স্ত্রী,কখনো কৈশোর প্রেম, আবার জীবনের ছুটে চলা অপরূপ পূর্ণ চাঁদ, ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ঝিলমিল আলোÑযাকে অবলম্বন করেই কবি আপ্লুত,তৃপ্ত। কুড়িয়ে পাওয়া ভাটফুল, শাপলাফোটা পুকুর, কিংবা সাঁতার দেয়া নদীর ঢেউ বন্দিত ও ছন্দিত হয়েছে মাত্র।
‘অন্তরা’ ই কবিকে জীবন দিয়েছেন, রঙিন ধরায় বাঁচতে শিখিয়েছেন, সাতরঙা প্রজাপতি চিনিয়েছেন। কবির ভাবনা জগতে কবে কখন কী যেন শুন্যে মিলিয়ে যাওয়া, আবার হাতছানি, আসে আর যায়। এই ঘোরলাগা আসা যাওয়ার মাঝে কবির হাবুডুবু খাওয়া, আনন্দবেদনা ও সঙ্গীতময় জীবন।
গ্রন্থের ভূমিকায় প্রথিতযশা লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী কবিকে আবিষ্কার করেন এইভাবে–‘তিনি যে নারীকে অন্তরে দেখেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে হয়তো তিনি আর কেউ নন, তারই অন্তরে বাস করা কেউ’. . .। তিনি আরো বলেন,–‘ তার প্রেমের কবিতাগুলোতে অলৌকিকত্ব রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে বাস্তব জগতের স্পর্শ এবং হাসি কান্নাও। আমি তার হাতে কবিতার আরো পদ্ম ফুটেছে দেখতে চাই’।
পাঠক হিসেবে এই আশাবাদ আমারও। কবি নিজে বলেন, অন্তরা আমার কবিতার রানী, সে সব সময় বিরাজ করে আমার মনের মণিকোঠায়।’ তিনি অন্যভাবে বলেন, ‘অন্তরা আমার বাস্তব জীবনে কখনো ছিল না, এখনো নেই।’ . . .‘আমার অনুভুতি, প্রত্যাশা, সুখ, ক্ষোভ, দু:খ প্রকাশ কিংবা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার উপলক্ষমাত্র।’
তবে, তার কবিতার ভেতরে প্রবেশ করলে যে কোন পাঠক বিচলিত হয়ে ভাববেনÑমাধুর্যময় জীবনের অলিগলির কথা কী অসম্ভব সহজ ও সরল কথায় তুলে এনেছেন কবি।
উদাহরণ–অন্তরা-১ কবিতায়Ñ‘ আজ পূর্ণিমা!/ পূর্ণ চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে।/চারপাশজুড়ে জোৎ¯œার খেলা/ জোনাকির ঝিঁঝিঁ রবে ভরে গেছে এই রাত।/ মনে পড়ে অন্তরা,/ কত পূর্ণিমা কাটিয়েছি তুমি আর আমি?’। . . .‘পূর্ণিমা আসে আর যায়Ñ/ কিন্তু তুমি তো নেই পাশে/ মনে হয় আমি শূন্য. . .!
এই কল্পনা ও স্বপ্নচারি জগত কবির জীবনে ছিল এক অমোঘ কুহক। হাহাকার রয়েছে সর্বত্র, সব কবিতায়। ২৩টি ‘অন্তরা’ কবিতায় ভরা টাস-বুননে আর্তি ঝলসে, খলকে উঠছে বার বার। এ যেন না-থামা জীবনের ঢেউ। ছুঁয়ে দেখার নয়, অথচ বিরাজ করছে চারদিকে শুন্যতার চিত্রময় ফানুস। এই ফানুস ফাফা, না আশানিয়া কে বলবে এই পড়ন্ত সূর্য আভায়?। সহ¯্র প্রশ্ন নিয়ে কবির কবিতা। নিরন্তর জিজ্ঞাসা পাঠককে কঁম্পিত করে, নির্ঘুম করে তুলে। কবির ভাবনা তখন আর একার থাকে না, হয়ে যায় সার্বজনীন।
কবি শাহ ফারুক আহমদের অন্য কবিতাগুলো দেশপ্রেম আর সমাজ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। স্বাধীন দেশের নানা পীড়ন, অসংগতি, শত্রæর বিচরণ কবিকে তাড়িত করে। এমনি প্রশ্নবিদ্ধ কবিতা ‘স্বাধীনতা’, আমার দেশ আমার জন্মভূমি’, ‘ক্ষমা করো জীবনানন্দ,’ ‘নির্বাক পৃথিবী’ প্রভৃতি।
‘স্বাধীনতা কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন,–‘স্বাধীনতা তুমি হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত প্রদীপশিখা/স্বাধীনতা তুমি লক্ষ লক্ষ শহিদের রক্তে নিঙড়ানো অকৃত্রিম ভালবাসা!/ স্বাধীনতা তুমি বাঙালির জাতির মহান নায়ক বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবতা।/ এরপরই কবি প্রশ্ন করেনÑ‘স্বাধীনতা তুমি কি এখন সন্ত্রাসীদের হাতে বন্দী?/ স্বাধীনতা তুমি কি দুষ্ট রাজনীতির হাতে বন্দী?’
আরো প্রশ্ন বিদ্ধ কবিতা ‘আমার দেশ, আমার জন্মভূমি’। এই কবিতায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে গর্জে ওঠেন–‘ হে স্বদেশ আমার প্রিয় জন্মভূমি–/ আর কত রক্ত চাও!’
এই কবিতার শেষাংশে বলেন, ‘নিজের স্বার্থকে দূরে রেখে,আমরা কি পারি নাÑ/ তোমাকে মনের মাধুরী দিয়ে সাজাতে?/’।
সবশেষে কবির বিদেশবিভূইয়ের পরবাসী জীবন কাতর করে তুলে। তিনি বেদনা বিধুর উচ্চারণে বলেন–‘হে প্রিয় মাতৃভূমি আর কতদিন,কতকালÑ/ আমাকে পরবাসে আটকে রাখবে তুমি!/ আর কি আমায় টেনে নেবে না তোমার বুকে?/ কতদিন যে দেখিনি তোমারÑ/ মন মাতানো বসন্তমেলা, রোদেলা দুপুর আর মায়াবি পূর্ণিমা!/ কতদিন শুনিনি শিমুলের ডালে বসা কোকিলের কুহুতান!’।
আক্ষেপ ভরা কম্পমান কণ্ঠে আরো বলেনÑ‘অনেকদিন অনেক কাল ধরেÑ/ শুনিনি নৌকায় পাল তুলে মাঝির কণ্ঠ/ সেই উদাস করা পল্লীগান আর/ মরমী বাউলদের মালজোড়া গান।/ পাশের বাড়ির চাচার কণ্ঠে বিরহ বিচ্ছেদ ভরা ‘বিননের কিচ্ছা’।
বাংলাদেশের মত শান্তিময় প্রকৃতিশোভা, পাখির অলস কূজনে ছন্দিত আকাশ, বিরহবেদনাক্রান্ত জীবন সন্ধানি কাহিনির টান টান উত্তেজনা, মাঝির গান আর বাউলদের ভূবন-কাঁপা মরমিয়া আলো-আধাঁরি সন্যাস-যাপনের পাতালভেদী সুরÑ দীর্ঘ পরবাস কবিকে উদ্বেল করে তুলছে।
‘বিজয় ভাবনা’ কবিতায় কবির সখেদ উচ্চারণ। তিনি বলেন,-‘ আমি কি বিজয়ের কথা বলছি/ আমি আমার আজীবনের লালিত স্বপ্নের কথা বলছি।/ আমি আমার চেতনা অনুভুতির কথা বলছি/ আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি/ আমি আমার ত্রিশলক্ষ শহিদের কথা বলছি/ আমি ইজ্জত হারানো মা-বোনের কথা বলছি’।
কবিতার শেষ পঙক্তি একটি নয়া সমাজ গঠনের কথা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বৈশ্বয়িক সমতার কথা উঠে এসেছে একটি অসাম্প্রদায়িক মহিমায়। তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলেন কবিÑ‘আমি ভেঙে দিতে চাই সাম্প্রদায়িকতা,/ যে আগুনে পুড়ে আমি চারখার হচ্ছি দিবানিশি।/আমি গড়তে চাই একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ দেশ।’
একজন কবির প্রেম, জীবনঘনিষ্ট নানা বাকে বিচরণ, দেশপ্রেম, মাতৃভূমির টান, নাছোড় বিপ্লবী তেজই জীবনের আরাধ্য। কবি শাহ ফারুক আহমদের সমগ্র কাব্যপাঠ কোন পাঠককেই বিমুখ করে না,করবে না। তার ‘অন্তরা’ পড়ে যে কোন পাঠকের ঘোর লাগবে আশাবাদ ও স্বপ্নময় জগতে ডুবে।
কবিতাগ্রন্থ আলোচনার পর নিপাট একটি নিবন্ধগ্রন্থ সত্যিই মুগ্ধকরা নাম ‘চিন্তার কথা ভাবনার কথা’ নিয়ে কিছু আলোকপাত করার বাসনা রোধ করা যায় না। শাহ ফারুক আহমদ যতটুক কবি তার চেয়ে তিনি বিষ্ময়করভাবে সমাজ সচেতন একজন প্রতিবাদী ও মানবিক মানুষ। সমাজে নির্লিপ্তভাবে বসবাস বেশিরভাগ মানুষের। ‘সাতেও নেই, পাঁচেও নেই’ এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু শাহ ফারুক আহমদ ব্যতিক্রমী চিহ্নায়িত একজন, সমাজকে নতুনভাবে গড়ার চিন্তায় বিভোর থাকা তার দিবারাত্রির চিন্তারক্ষেত্র। তাই তার গ্রন্থের নামই স্পষ্টভাবে স্বনিষ্ঠ নামলিপি যে কোন পাঠককে আকর্ষণ করে নিরন্তর, নির্দ্বিধায়।
গ্রন্থের সূচীপত্র অনেক দীর্ঘ হলেও পাঠকমাত্রই আকৃষ্ট করে শিরোনামগুলো। বিশেষত আবেদন সৃষ্টিকারি লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস,’ ৩০ বছর ধরে এক টাকার শিঙ্গারা বিক্রি’ ‘ধর্ষণ-বলাৎকার মামলাগুলো সক্রিয় করুন’ ‘বিলেতে বাংলা ভাষাকে বাঁচান’ ‘ভাষ্কর্য নয়, শিশু বলাৎকার বন্ধ করুন,’ ‘ বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা,’ ‘এরা কারা, কোন অদৃশ্য শক্তি এদের পিছনে?’ ‘বিকৃত করে ইতিহসের সত্য আড়াল করা যায় না’, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিকল্প নেই,’ কুচক্রীমহল বিভ্রান্তি ছড়ায়’, সুশাসন ছাড়া উপায় নেই’, আসুন আমরা বই পড়ি ইতিহাস জানি,’ তরুণরা পারে দেশের চেহারা বদলে দিতে’ সহ ৬০টি নিবন্ধ।
‘চিন্তার কথা ভাবনার কথা’ গ্রন্থখানা পড়ে পাঠক তার মনের সাথে একটি বোঝাপাড়া করতে উদ্বুদ্ধ হবেনÑ কেমন জীবনব্যবস্থা ধারণ করা জরুরী। শাহ ফারুক আহমদ পাঠককে একটি পূর্ণাঙ্গ দিগনির্দেশনা দিয়েছেন সমগ্র গ্রন্থটিতে।
‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবসকে তিনি এইভাবে চিহ্নিত করেনÑ‘পাকিস্তানি কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে বীরের মত বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘স্বাধীন স্বদেশ’ প্রত্যাবর্তন বিশ্বের সব ইতিহাসকে পিছনে ফেলে দিয়েছে’। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল একটি অমর ইতিহাস। ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মাতৃভূমি তখন যুদ্ধে বিধ্বস্ত। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত¯œাত আর দু লক্ষ মাবোনের নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু যদি গদির প্রলোভনে আত্মসর্মপন করতেন, তবে দেশ স্বাধীন হত না। তিনি আত্মসর্মপন করেননি, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ফাঁসির ভয় উপেক্ষা করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস। জাতির প্রতি তার সুদৃঢ় আস্থা ছিল,তাই জাতিও যুদ্ধ করে দেশকে শত্রæমুক্ত করে এবং মুক্ত দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন বীরের বেশে।
‘৩০ বছর বছর ধরে ১ টাকায় শিঙ্গারা বিক্রি’ নিবন্ধটি সমাজে সমতা সৃষ্টির একটি বার্তাবহ। নিবন্ধটি ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত একটি ফিচার। একজন সত্তোর্ধ ব্যক্তি যার নাম ছোলেমান হোসেন বাহাত্তর সাল থেকে এক টাকায় শিঙ্গারা বিক্রি করেন। ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তিনি দাম বাড়াননি। সাধারণ গরীব সন্তানদের কথা মাথায় রেখেই তার এ দাম না-বাড়ানোর শিঙ্গারা বিক্রি। সমাজের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় এই বয়োবৃদ্ধের এ সামান্য উদ্যোগটি একটি অসামান্য বার্তা বহন করে। লেখক প্রথম আলোর এই নিবন্ধটি উদ্ধৃত করে দেখাতে চেয়েছেন, অপকর্ম করে যারা সমাজে শোষণ ও প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে, টাকার কুমির হচ্ছে, তাদের জন্য এটি একটি চপেটাঘাত।
‘ধর্ষণ-বলাৎকার মামলাগুলো সক্রিয় করুন’ নিবন্ধে ব্যভিবিচারকে অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কাজ ঘোষণা করা হয়েছে ইসলাম ধর্মে। জাগতিক রাষ্ট্রে এর দন্ড প্রশ্নাতীতভাবে সর্বোচ্চ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শাস্তির ব্যাপারে সমাজ রাষ্ট্র ততটুকু উদ্যোগী নয়।
‘বিলেতে বাংলাভাষাকে বাঁচাতে হবে’ নিবন্ধটি বিলাতে বাঙালি কমিউনিটিতে বাংলাভাষা চর্চা অব্যাহত রাখার আন্দোলন নিয়ে লেখা। আমাদের অভিবাসনের অতীত আন্দোলনের ফসল বিলেতে স্কুলগুলোতে বাংলাভাষা পাঠদানে অর্ন্তভুক্ত করা। কিন্তু সম্প্রতি সরকারের একটি মহল কমিউনিটি স্কুলসহ জিসিএসি এবং এ লেভেল থেকে বাংলাভাষা উঠিয়ে দিচ্ছে। এতে শতাধিক শিক্ষকের চাকরি যাওয়া ছাড়াও ৪৭টি কমিউনিটি স্কুল বন্ধ হবে, প্রায় দুহাজার শিক্ষার্থী বঞ্চিত হবে বাংলা মাতৃভাষা চর্চা থেকে। মাতৃভাষাকে বিলেতে টিকিয়ে রাখতে বা বাঁচাতে কমিউনিটিকে এগিয়ে আসার আহবান এখানে সোচ্চারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ নদনদী বিধৌত একটি পলি উর্বর ব-দ্বীপ। এটির নদনদীর তীরবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে একটি গোষ্ঠী নানা স্থপনা গড়ে তুলছে। এমনকি নদী দখল করে নিচ্ছে। যার ফলশ্রæতিতে নদনদী নাব্যতা হারাচ্ছে, নদী ভরাট হয়ে ক্ষীণ হয়ে ধুকছে। তিনি ‘কারা এই দখলদার?’ উক্ত নিবন্ধে লিখেছেনÑ ‘ক্ষমতার দম্ভ-অহংকারে দেশের বুকে এরাই ছুরিকাঘাত করে, এরাই দেশের সম্পদ লুটপাট করে। রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী আমলাসহ প্রায় ৫০ হাজার প্রভাবশালি ব্যক্তি সারা দেশে নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে।’ নদী রক্ষা কমিশন সুত্রে জানা গেছেÑদেশের অভ্যন্তরে ৪০৫ নদী এবং ৫৭টি আন্তদেশীয় নদী রয়েছে। নদনদীর জেলাওয়ারী একটি তালিকা দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন নদী দখল কত ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এতে জীবনব্যবস্থার ওপর পড়া ঝুঁকির মাত্রা কী পরিমাণ ক্ষতিকর তা বিশ্লেষণ করে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়ার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের উদ্যোগী হতে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
‘ভাষ্কর্য নয়, শিশু বলাৎকার বন্ধ করুন’। সমাজে ঘাপটি মেরে বসে-থাকা এক শ্রেণীর মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে আমরা নিস্পৃহ। কিন্তু তারা সমাজে দুষ্টচক্র। এ ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তিনি লিখেছেন,–‘ আমাদের শ্রদ্ধেয় ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেব সুন্দর এবং খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তিনি হুজুরদের উদ্দেশে বলেছেন,-‘ভাষ্কর্য নয়, আগে নিজেদের চরিত্র ঠিক করুন, মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার বন্ধ করুন।’
এই ছোট্ট আহবানের মর্মে রয়েছে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ভাঙনের নানা সবিরোধী অবস্থান ও আচরণÑ যার পরিণতি ভয়াবহ। যারা চিৎকার দিচ্ছেন, ভাষ্কর্য অনৈসলামিক, তারাই শিশু বলাৎকারের মত জঘন্য অপরাধে লিপ্ত। এখানে বিষ্ময়।
তিনি আহবান জানিয়েছেন,-এদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। কারণ এরা দেশে পবিত্র ইসলামের নামধারী মৌলবাদ,সন্ত্রাসবাদ,জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, বর্ণবাদ সৃষ্টি করে দেশে একটি সামাজিক রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে, তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। এরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যহত করতে চায়।’
গ্রন্থটিতে মাদকের ছোবল ও বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে তার উদ্বেগাকাঙ্খিত নিবন্ধ রয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচার করেন বেশি সরকারি চাকুরেরা। তা তথ্য উপাত্ত দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, এরা লুটেরা ঘুষখোর। এদের নিয়ন্ত্রণ না করলে দেশের ক্ষতি চলতেই থাকবে, আর সমাজকে দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা যাবে না। দেশ থাকলে কুচক্রীমহলের চক্রান্তও থাকবে। তার ‘কুচক্রীমহল বিভ্রান্তি ছড়ায়’ নিবন্ধে এমনি আশংকার কথাই বিবৃত করেছেন।
‘সুশাসন ছাড়া উপায় নেই’ নিবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য উদ্বৃত করেছেন। বক্তব্যটি হলÑ‘আমি ২৫ বছর পাকিস্তানি বেজন্মাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জেল-জুলুম সহ্য করেছি বাংলদেশকে স্বাধীন করার জন্য, আর এক শ্রেণীর সাদা কাপড়ের লোকেরা লুটেপুটে খায়, বাঙালির দু:খ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই’। বঙ্গবন্ধু সুশাসনের অভাবের কথাই ব্যক্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা বলতে শাহ ফারুক আহমদ ‘আসুন আমরা বই পড়ি, ইতিহাস জানি’ নিবন্ধে লিখেছেন,Ñ‘বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যারা পড়বে তারা কোনোদিনই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করার, অশ্রদ্ধা করার কোন প্রয়াস পাবে না। বরং শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় বঙ্গবন্ধুকে অন্তরের অন্তস্থলে গভীর ভালবাসায় লালন করবে।’।
পরিশিষ্টে লেখক ও গ্রন্থখানা সম্পর্কে কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্ব পাÐলিপি পড়ে প্রণিধানযোগ্য কিছু মন্তব্য করেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, শিক্ষাবিদদের মধ্যে হাসনাত মোহাম্মদ হোসেইন, ডা. ফয়জুল ইসলাম, ফয়জুল ইসলাম লস্কর, মুহম্মদ মনির হোসেইন, শিরাজ উদ্দিন আহমদ ফরহাদ, ইকবাল হোসেইন, মো. আবু হোসেন, সেলমি উল্লাহ ও আফজল হোসেন সিদ্দিক মিয়া। এছাড়া ভূমিকাপর্বে মন্তব্য লিখেছেন বিশিষ্টজনদের মধ্যে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ও রাজনীতিক সংস্কৃতিকর্মী হরমুজ আলী। গুণীজনদের এসব মন্তব্য অবশ্যই প্রেরণাদায়ক এবং উৎসাহব্যঞ্জক।
এছাড়া আলোচনায় গ্রন্থদ্বয়ের মুদ্রণ নিয়ে কোন কথা বলা লেখকের দায় নয়। এটি যারা মুদ্রণ কাজে জড়িত তাদের ওপর বর্তায়। বানান বিভ্রাট তেমন নেই, যা আছে তা তাদেরই ত্রæটি। বাক্য গঠনে তেমন কোন আটকে যাওয়ার মত কোন ভ্রান্তি নেই। পাঠক গতি নিয়েই পাঠ করতে হুমড়ি খাওয়া বা হোঁচট খাওয়ার শংকা খুব কম। মুদ্রণ ঝরঝরে। শোভন মুদ্রণ। প্রচ্ছদ অর্থবহ। প্রকাশকাল ‘অন্তরা’ ফেব্রæয়ারি ২০২১ এবং ‘চিন্তার কথা ভাবনার কথা’ মার্চ ২০২১। দুটি গ্রন্থই সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে, পাঠ সুখগ্রাহী। শেষাবধি দুটি গ্রন্থ উপহার দেয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ এবং অভিন্দন।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক