সরকারী নিরাপত্তায় বিক্ষুব্ধ জনতা আসলে কারা?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সিলেটের একটা সীমান্তে গতরাতে আটক হয়েছেন। এটা পুরনো খবর। আজকের খবর হচ্ছে তাঁকে আদালতের তোলা হয়। এগুলো স্বাভাবিক।
অস্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে, তিনি আদালত প্রাঙ্গণেই আক্রান্ত হয়েছেন। আদালত প্রাঙ্গণের রাষ্ট্রীয় কঠোর নজরদারি এবং নিরাপত্তার মধ্যে তাঁকে লক্ষ্য করে ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কারা করেছে, তাদের কী পরিচয় এটা অজ্ঞাত। ধারণা করা হচ্ছে, বিচারিক ব্যবস্থার সীমানার মধ্যে থেকেও বিচারবহির্ভূত এই কর্মকাণ্ড বিচারের আওতায় আসবে না, এমনকি তদন্তও হবে না।
সাধারণত এসব ঘটনাকে মিডিয়া এবং অতি-উৎসাহীরা ‘বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে, কিন্তু আদালত এমনই এক ব্যবস্থা, এর সীমানা এবং প্রাঙ্গণ এমনই জায়গা যে যেখানে সাধারণেরা অবস্থান করে না। এবং আলোচিত-সমালোচিত যাই হোক না কেন এমন কোন ব্যক্তিত্বের প্রতি সাধারণের কথিত ক্ষোভের প্রকাশ এমনভাবে হয় না। সাধারণেরা সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত, এবং যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে তারা নিজেদের দূরে রাখে।
আদালতের তোলার সময়ে কয়েকটা যুবককে বিচারপতি মানিককে মারতে উদ্যত হতে দেখলাম। একজনের উচ্চারণ শুনলাম সাবেক এই বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলছে, ‘জানোয়ারের বাচ্চা, কাফির শুয়োরের বাচ্চা’। দেখুন কত সহজেই একজনকে ‘কাফির’ আখ্যা দিচ্ছে আরেকজন। উল্লিখিতদের এই কর্মকাণ্ড বলছে, তারা আদালতের মধ্যে থাকা এবং তাঁকে মারতে আসা কেউ। এদেরকে তাই সাধারণ জনতা বা বিক্ষুব্ধ জনতা বলার সুযোগ নাই।
সিলেটের আদালতে বিচারপতি মানিককে বিধ্বস্ত দেখা গেল। তার পরনের শাদা পাজামাতে ছোপ ছোপ রক্তের দেখাও মিলল। এই রক্ত নিশ্চয় তাঁর দেহ থেকে উপচে এসে পড়ে যায়নি। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিচারবহির্ভূত কোন কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। কী ঘটনা তবে?
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের প্রতি অনেকের ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু এই ক্ষোভ তাঁকে শারীরিক নিগ্রহের যুক্তি হতে পারে না। তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে সেটা আইনি প্রক্রিয়াতেই প্রতিবিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আইনি প্রাঙ্গণে এমন আইন-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই উচিত নয়।
তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক হতে পারেন। তাঁর এই রাজনৈতিক বিশ্বাস তাঁকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে না। বরং তাঁর বিরুদ্ধে যে সব মামলা হয়েছে, সে সব যদি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ হয়ে থাকে, তবে আদালত নিশ্চয় এর বিচার করবে। তাই বলে এভাবে এমন অবস্থায় দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন, একজন অসুস্থ বৃদ্ধ, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কেউ হেনস্থা করতে পারে না; সে অধিকার কেউ রাখে না।
‘নিউ নরলাম ইন্টেরিম ইন্ডিপেনডেন্স’-এ আপনি যদি নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবেন, আদালত প্রাঙ্গণে যদি আপনি কথিত স্বাধীনতার নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তোলে নেন, তবে এটা যে আরেক ফ্যাসিজম; এ আপনাকে কে বুঝাবে?
ভাববেন না, কেউ প্রতিবাদের নেই বলে সব হালাল হয়ে যাবে। কিন্তু সময় যে অদ্ভুত মহাজন, যার কাছে সব লিখিত থাকে, সোশ্যাল মিডিয়া যে অদ্ভুত যাদুঘর যেখানে সব লিপিবদ্ধ থাকে। চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেন না।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক সম্পর্কে আপনি খারাপ ধারণা পোষণ করতে পারেন, এতে আমার সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হলো যখন আপনি তাঁর বা অন্য যে কারো প্রতি মারমুখী হবেন। এই অধিকার আপনি রাখেন না। আপনি চরম মাত্রায় স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদ আপনার ধমনিতে নিয়ত প্রবাহিত হলেও আপনি এ অধিকার রাখেন না।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের প্রতি এমন অপমানজনক এবং ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে হয়ত অনেকেই ভাবতে পারেন, আপনারা বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু আদতে আপনারা যাকে নিজেদের বিজয় ভাবছেন, সেটা আদতে অন্তর্বর্তী সরকারের পরাজয়। আইন শৃঙ্খলা, নিয়মনীতির প্রতিপালনে ব্যর্থতার উদাহরণ। এটা প্রমাণ করে দেশ কতখানি অস্থির এখনো, দেশ কতখানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকারের।
এই যে চিত্র এটা কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন যদি ভাবেন, তবে এটা আপনার চিন্তার দৈন্য। তাঁকে আক্রমণের এই ঘটনায় চোখ রাখবে নিশ্চয় বিদেশি মিডিয়া ও বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা। তারা কেবল বিচারপতি মানিকই নয়, সকল মামলায় কীভাবে রাষ্ট্র অভিযুক্তদের প্রতি আচরণ করছে সেটাও দেখছে। আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আচরণ, প্রশাসন-সরকারের প্রতিক্রিয়া সব দেখছে। এখানে মানবাধিকারের কতখানি প্রতিপালন হচ্ছে, সেটাও দেখছে সবাই।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের উদ্দেশ্যে ডিম ও জুতা নিক্ষেপের ঘটনায় আপনারা অনেকেই হয়ত আনন্দিত, কিন্তু এটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যে বিব্রতকর। মনে মনে এমনটা অনেকে চাইলেও, শক্তিশালী কোন প্রশ্নের মুখে পড়লে ‘সাধারণের প্রতিক্রিয়া’ উল্লেখে পার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।