সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কিভাবে ছড়াচ্ছে
রুহুল কুদ্দুস বাবুল
সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের পরিচর্যায় সাম্প্রতিককালে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ওশাজ মাহফিলগুলোর অবদান কম নয়। ওয়াজ মাহফিল আমাদের দেশে নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আগেকার দিনে ওয়াজ মাহফিলে জ্ঞানতাপস আলেম ওলামা বয়ান করতেন। তাঁরা ইমান, আখলাক(আচরণ), ইবাদত, আখেরাত সম্পর্কে নসিহত করতেন। অর্থাৎ হেদায়েতের দাওয়াত দিতেন। তাঁরা ছিলেন ওলামায়ে হক্ক।
এ যুগে ওলামায়ে হক্ক নেই। আছে ওলামায়ে দুনিয়া। এসব আলেম নামধারী ব্যাক্তিরা টাকার বিনিময়ে মাহফিলে বক্তৃতা করে। এ প্রসংগে দেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসউদের উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে থেকেই মাহফিলের অবয়ব পাল্টাতে থাকে। স্বাধীনতার পর মাহফিল ইসলামি ভাবগাম্ভীর্য থেকে বেরিয়ে আসে। আগে যারা ওয়াজ করতেন তাদের ইলম, আমল, ত্বাকওয়া সবই ছিল। তাদের কোনও ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। নব্বই দশকের পর ওয়াজ মাহফিল বাণিজ্যনির্ভর হয়ে ওঠে। এখন এটি ব্যাপকতর আকার নিয়েছে।”
ইদানিংকালের ওয়াজ মাহফিলে যেসব বক্তৃতা হয় যেগুলোতে ধর্মীয় অনুশাসন বা ধর্মীয় রীতিনীতি প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টির বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের কথাবার্তা বেশি প্রাধান্য পায়। ধর্মে অজ্ঞ কিন্তু ধর্মপ্রাণ সমাজে এর প্রভাব ব্যাপক এতে কোন সন্দেহ নেই। দেশের গ্রামে-গঞ্জে, ইউটিউবসহ সামাজিক নেটওয়র্কের মাধ্যমে কিছু বক্তা ওয়াজে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদে উৎসাহ দিচ্ছে। একইসাথে এই বক্তারা নারী অধিকারসহ দেশে সংবিধান ও শাসণ ব্যাবস্থা নিয়ে বিভিন্ন কায়দায় ভুল তথ্য দিয়ে উস্কানি দিচ্ছে। এসব মাহফিলে নব্য রাজনীতিবিদরাও অংশগ্রহন করে পৃষ্ঠপোষকতাও দেয় যে কারণে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরব থাকতে হয়।
এমনটা কেন হল এরও একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক আছে।
রাজনৈতিক দিক হলো গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুপস্থিতি। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অব্যাহত অনুপস্থিতি পরিস্থিতি আরো প্রকট করে তুলছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদ্বেগজনক নিষ্ক্রীয়তার সুযোগে অগণতান্ত্রিক গণবিরুধী অপশক্তি জায়গাটি দখলে নিচ্ছে। দিনের পর দিন দেশে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ-মুলক রাজনীতি না থাকায় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোও এই ধরণের ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে দেশে প্রায় ৩০ টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এসব দলের অধিকাংশ নেতারাই ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বক্তৃতা করে। এরা হেলিকপ্টারে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ করতে যায়। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার দিক হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক গণসম্পৃক্ত রাজনীতির অভাবে এমন সব মৌলবাদী রাজনৈতিক অপশক্তির প্রভাব বাড়ছে যারা তুলনামুলকভাবে অধিকতর রক্ষণশীল। তারা এমন সব ধারণা উপস্থিত করছে যা সমাজ প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক।
আর অর্থনৈতিক দিক হল স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশে নতুন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী মাথা তুলেছে। এরাও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রাখছে। এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ধর্মীয় আচরণকে লোকচক্ষে দেখানো যা ইসলাম ধর্মীয় পরিভাষায় রিয়া বলা হয়। এই লোক দেখানো একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। অনেকের স্মরণে থাকার কথা স্বৈরশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ হজ্জ্ব পালন করে এসে এক জনসভায় বললেন ‘আমাকে এখন আলহাজ্জ্ব হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ বলবেন’। ক্ষমতার রাজনীতিতে এ প্রবণতা এখন আরও ব্যাপক। এটা করতে গিয়ে সমাজ এবং রাজনীতিকে তারা প্রভাবিত করছে। এটা আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের একটা সুফলও বটে। আমাদের সমাজে ধর্মের উদযাপন এবং বাহ্যিক প্রকাশ অনেক বেড়ে গেছে এ কথা অত্যুক্তি হবেনা। এর অন্যতম কারণ অবৈধ উপার্জন বেড়ে যাওয়া। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অঢেল অবৈধ টাকা। ঘুষ, দুর্নীতি, মজুদদারী, অবৈধভাবে জায়গাজমি দখল, লুটপাট করে যারা পয়সা কামায় এরা ইহকাল তো বটেই পরকালেও বেহেন্তা সুখ কামনা করে। অবৈধ হারাম কামাইয়ের কিছুটা ব্যয় করে পরকালের জন্য। এ সুযোগটিও ধর্মব্যবসায়ীরা সুনিপুনভাবে কাজে লাগায়। রাজনৈতিক দলগুলোও কম প্রভাবিত হচ্ছেনা। তারাও বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত।
ধর্মনাশা সর্বনাশা সমাজবিধ্বংসী এ পথ থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলসমুহ সরে আসতে হবে। সেইসাথে অতি জরুরী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা এবং প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনীতির রাজপথে সরব উপস্থিতি।
লেখক: রাজনীতিক, সাবেক ছাত্রনেতা