স্বাধীনতার ৫০ বছরের অনুভূতি
আকবর হোসেন
আজ ২৬শে মার্চ। ১৯৭১ সালের এদিনে শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ বছর আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি। ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চারদিকে সাজ সাজ রব, উৎসবের আমেজ। দেশের গন্ডি পেরিয়ে যেখানেই বাংলাদেশের মানুষের বসবাস সেখানেই পালিত হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। লাল সবুজের একটি পতাকা, স্বাধীন একটি ভূখন্ড আর শোষণবঞ্চনামুক্ত আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে দুনিয়ার বুকে দাঁড়াবার জন্য যারা অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিলেন সে সকল বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হলো আমাদের এই স্বাধীনতা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার সকল শহীদ-গাজী ও যুদ্ধাহত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি, যারা আপনজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে ধুকে ধুকে দিনযাপন করছেন, যাদের চোখে আজো ভেসে উঠে সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দৃ্শ্য, আজো কানে বাজে নিষ্ঠুর হানাদারদের উদ্ধত রাইফেলের গুলির বিভৎস আওয়াজ, মনের মণিকোঠায় আজো জমে আছে প্রিয়জনের কতো কথা! কতো স্মৃতি – যারা ঘাতকের বুলেটে ঝাঝরা করা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে চলে গেছেন ‘ওপারের সুন্দর জীবনে‘ আর দিয়ে গেছেন মুক্তি, বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা।
আসুন এবারের রজতজয়ন্তীতে আমরা আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় করি। যে সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বসুরীরা তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ সকল জাতীয় নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
অর্ধ শতাব্দী একটি জাতির জন্য কম সময় নয়। সময় এসেছে এবার হিসেব নিকেশের। পেছনে ফিরে তাকালে দেখি অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। আর সামনে তাকালে দেখি আমাদের আরোও অনেক দুর যেতে হবে। কারণ যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম তা‘ আজো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের যেনো আরো অনেক পথচলা বাকী আছে। সে পথ ধরে আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি। তবে টানেলের ওপারে নুতন উষার আলো যে উঁকি দিচ্ছে তা‘ কিন্তু টের পাচ্ছি। সুতরাং আশাবাদী না হয়ে থাকার কোন উপায় নেই।
উন্নয়ন হচ্ছে, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, তবে নৈতিকতার উন্নয়ন হয়নি একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দুর্নীতি কুরে কুরে খাচ্ছে সব উন্নয়ন ও সাফল্যকে। স্বাধীন এদেশটাকে লুটে পুটে খাচ্ছে এক শ্রেনীর দূর্নীতিবাজ যুগ যুগ ধরে। এদের রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে আজ ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ভুলে, দলমতনির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। এদেশ আমার আপনার সকলের। কারো কোন দান দক্ষিণায় আমরা এ দেশ পাইনি। এজন্য আমাদের মাটির বীর সন্তান, আমাদের পূর্বপুরুষরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, এজন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন, তারপর বাস্তবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বানিয়ে দিয়ে গেছেন। এখন আমাদের একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত আর তা‘ হলো দূর্নীতিমুক্ত একটি দেশ গড়া। নৈতিকতার উন্নয়নে তাই নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।
পরাধীন দেশে জন্ম হলেও স্বাধীন দেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছি। জীবনের একটি মূল্যবান সময় দেশে কাটিয়েছি। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে আজ জীবন জীবিকার তাগিদে দেশের বাইরে থাকলেও মন পড়ে থাকে জন্মভূমিতে। তাইতো সুখে দুখে আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকি, চিন্তা চেতনায় অনুভবে সবুজ শ্যামল সেই বাংলায় মন পড়ে থাকে। যখনই সুযোগ আসে তখনই ছুটে যাই মায়ের কোলে। আপন জন আর পাড়া প্রতিবেশির মায়া মমতায়, নদীনালা, গাছপালা, খালবিল, হাওরবাওড়, পুকুর, ফুল পাখি, গানে মুখরিত আকাশ বাতাস, ফসলের মাঠ, ভাটিয়ালী সুর, পালতোলা নৌকা, আউল বাউলের একতারার সুর, রাখালিয়া গান, মাঠে ঘাটে, লাঙ্গল জোয়ালে, খেতে খামারে, গাঁয়ের মেঠো পথে, মিনারের আজানে, শয়নে স্বপনে জাগরণে দেখি সেই আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
ছোটবেলায় কতো কবিতা, কতো গান, স্বাধীনতা দিবসের মিছিলে গগণবিদারী শ্লোগানে মুখরিত করে রেখেছি রাজপথ আর ষ্টেজ। স্কুল কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ছিলো বেশ আকর্ষনীয় বিষয়। অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসবে একুশে ফেব্রুয়ারী, ছাব্বিশে মার্চ ও মহান বিজয় দিবস। সাধনা করতাম গান ও কবিতার। আমাদের পাইলগাঁও বিএন হাইস্কুলের আমাদের সময়ের প্রধান শিক্ষক বাবু আলয় কুমার কর ছিলন খুবই সংস্কৃতিমনা মানুষ। তিনি ভালো আবৃত্তি করতেন। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যোত ‘বিদ্রোহী‘ কবিতার পুরোটা ছিলো তার মুখস্থ। শুধু বিদ্রোহীই নয় অন্যান্য কবিতাও তিনি আমাদের শেখাতেন তন্মধ্যে, সুকান্তের ‘রানার‘, শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি‘ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান হতো। তিনি আমাদের দেশের গান গাইতে উদ্বুদ্ধ করতেন। দিজেন্দ্র লালা রায়ের বিখ্যাত গান ‘ধনধান্য পুস্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা‘ প্রথমে তার কাছ থেকেই শিখি। এছাড়াও আবু জাফরের লেখা বিখ্যাত আরেকটি গান ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে‘ আমরা সমবেত কন্ঠে গাইতাম। তখনকার সময়ে শুধু নিজেদের স্কুলেই প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ ছিলো না, আমাদের অন্যান্য স্কুলের অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে হতো। জাতীয় দিবসগুলোতে আমাদের এলাকায় বইতো এক আনন্দ বন্যা। কুশিয়ারার তীরের শহীদ-গাজীর স্মৃতিধন্য, ভাটি বাংলার অন্যতম নৌবন্দর রানীগঞ্জ বাজারের স্কুল থেকে আমরা পতাকাশোভিত শোভাযাত্রা বের করতাম। লাল সবুজের পতাকায় ছেয়ে যেতো পুরো বাজার। তারপর খেলোধুলা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হতো স্কুল মাঠে। এতে আলোচনা, উপস্থিতি বক্তব্য, ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, তেলাওয়াত, বিতর্ক, গান, কবিতা, কৌতুক সবই থাকতো।
আমাদের হেড স্যার বাবু আলয় কর ভালো ছবিও আঁকতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকতেন কয়লা দিয়ে। সাদা কাগজের উপর সে ছবি দারুনভাবে ফুটে উঠতো। তাকে ফলো করে বাড়িতে গিযে আমরাও আঁকার চেষ্টা করতাম। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পল্লী সাহিত্যের ক্লাস ভীষণ ভালো লাগতো। সে সময় রোমারোলা, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ইত্যাদি নাম জানা হয়ে যায়। তিনি সাহিত্যের আলোচনায় বলতেন, ‘সহিত‘ শব্দ থেকে সাহিত্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ মনের সাথে মনের, জীবনের সাথে জীবনের যে সম্পর্ক সেটাই সাহিত্য। আজো সে কথা মনে গেঁথে আছে। তার ক্লাসে আমাদের অনেক কিছু মুখস্থ হয়ে যেতো। সে অনেক কথা। আজ স্বাধীনতার অনুভূতির কথা লিখতে গিয়ে এসব স্মৃতি রোমন্থন করলাম। স্যারকে নিয়ে অন্যকোন সময় লেখার ইচ্ছা রইলো। সব প্রতিযোগিতায়ই পুরস্কার বিতরণী ছিলো অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আমাদের বন্ধুদের একটি গ্রুপ ছিলো যারা সবসময়ই পুরস্কার পেতাম। হোক সেটা গান, কবিতা কিংবা অন্যকিছু। সহপাঠি বন্ধুদের মধ্যে পল্লব, জয়ন্ত, বন্ধু রফিকুজ্জামান তারা ভালো গাইতো। ফজতুল (করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করে, তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি) ভালো ফুটবলার ছিলো। জহুর আলী (মাষ্টার) ভালো ভলিবল খেলতো। অন্যান্য বন্ধুদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
কেনো যেনো মনে হয় সে সময়ের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশে বেশ তফাৎ। এখন সব যান্ত্রিক। কারো সময় নেই। হৃদয়খোলা প্রাণবন্ত আড্ডা নেই। স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক নেই, বিনিময় ছাড়া উপহার নেই। মুখে হাসি আছে ঠিকই কিন্তু সে হাসিতে কোন প্রাণ নেই, প্রফুল্লতা নেই। হিংস্রতা বেড়েছে, মানবিকতাবোধ উধাও হয়েছে। তারপরও সবই আছে, আমরা সামনে আগাচ্ছি কিন্তু কোথায় যেনো একটি শুন্যতা বিরাজ করছে। প্রাণহীন এসব নগরী আর প্রযুক্তি যেনো আমাদের আত্মিক সম্পর্ককে কেঁড়ে নিয়ে গেছে। আমরাতো মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চাই, পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোর ঝলসানি উপভোগ করতে চাই, নির্মল আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে চাই, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, আমাদের পূর্বসূরীদের দেখানো সোনালী পথে হাঁটতে চাই। ফলে ফুলে সুশোভিত, ফসলে ভরা শস্য শ্যামল মায়া মমতাপূর্ণ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই স্বপ্ন ও স্মৃতির সেরা বাংলাদেশ ফিরে পেতে চাই।
“ধনধান্য পুস্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমনি দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি“
সবাইকে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভেচ্ছা।
আকবর হোসেন: লেখক, সাংবাদিক