হেপাটাইটিস সি আবিষ্কার: ২০ কোটি মানুষের বাঁচার আলো

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

পৃথিবীজুড়েই লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। অথচ ১৯৮৯ সালে সদ্য নোবেলজয়ী এই ত্রয়ীর গবেষণায় হেপাটাইটিস সি ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। এই সংখ্যাটি বিশ্বে এইডস রোগীর চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি।

যে সময়টায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নামগুলো ঘোষণা করা হয়, আমি তখন একটা প্রসিডিউরে। কাকতালীয়ভাবেই হয়তো হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত একজন লিভার ক্যানসার রোগীর লিভারের টিউমারটা বাইরে থেকে হিট দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার কসরতে ব্যস্ত। আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এর নাম আরএফএ। মার্কিন প্রবাসী এক সাংবাদিক বন্ধুর পাঠানো ফেসবুক লিংকটা তাই সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়েনি। নোবেলের উত্তাপটা টের পেলাম আমার একসময়ের ছাত্র আর এখন অনুজপ্রতিম সহকর্মী ডা. পার্থ প্রতীক রায়ের ফোনে। উত্তেজনায় টগবগ করছে লাইনের ওপারে, কথা বলতে গিয়ে আঁচ করছি স্পষ্ট। পার্থ আমাকে ফোন করেছে ২০২০-এর এই ধূসর সময়ে দারুণ একটা খবর দেয়ার জন্য। খবরটা আসলেই দারুণ! চিকিৎসাবিদ্যায় এবারের নোবেলের শিকেটা ছিঁড়েছে দুজন মার্কিন আর একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর কপালে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য ’৭৬-এ নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। আর হেপাটাইটিস সির জন্য এ বছরের নোবেল উঠল হার্ভে জে অলটার, মাইকেল হাউটন এবং চার্লস এম রাইসের হাতে। এর মাধ্যমেই সম্ভবত ষোলকলা পূর্ণ হলো হেপাটোলজির আর সে কারণেই অচেনা-অদেখা তিন ভিনদেশির সাফল্যে শিহরিত বিশ্বের দেশে-দেশে পার্থর মতো হাজারো লিভার বিশেষজ্ঞ।

পৃথিবীজুড়েই লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। অথচ ১৯৮৯ সালে সদ্য নোবেলজয়ী এই ত্রয়ীর গবেষণায় হেপাটাইটিস সি ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। এই সংখ্যাটি বিশ্বে এইডস রোগীর চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। প্রতিবছর আরো প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশের কমপক্ষে ১৫ লাখ নাগরিক এ ভাইরাসে আক্রান্ত। পাশাপাশি শঙ্কার জায়গাটি হচ্ছে এই যে, জনসচেতনতা তৈরি হওয়ায় উন্নত বিশ্বে যখন হেপাটাইটিস সির সংক্রমণ কমে আসছে, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সেই কার্ভটি ঊর্ধ্বমুখী।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাস মূলত ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। কাজেই ব্লাড ট্রান্সফিউশনের আগে তা হেপাটাইটিস সি ভাইরাসমুক্ত কি না, তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করাটা জরুরি। দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে অনেকেই নিজেদের অজান্তে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তা ছাড়া একই শেভিং রেজার, ব্লেড কিংবা ক্ষুর ব্যবহারের মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। সামাজিক মেলামেশা, যেমন হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি আর রোগীর ব্যবহার্য গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামাকাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। শরীরে একবার প্রবেশ করলে তা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে লিভারে স্থায়ী ইনফেকশন তৈরি করে, যাকে আমরা বলি ক্রনিক হেপাটাইটিস সি। আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। অথচ ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এদের বেশির ভাগই লিভার সিরোসিসের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন, যাদের অনেকেরই আবার লিভার ক্যানসার দেখা দেয়। আর তাই হেপাটাইটিস সিকে বলা হয় ‘তুষের আগুন’- ভেতরে ভেতরে লিভারকে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেললেও বাইরে থেকে বোঝা দায়!

হেপাটাইটিস সির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন নেই। তবে ইদানীং বাজারে কিছু নতুন ওষুধ এসেছে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এই ওষুধগুলো পাওয়া যায়। আর এসব চিকিৎসায় হেপাটাইটিস সি ভাইরাস এখন প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য। প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, তাহলে কেন নোবেল? কেন গুনে গুনে ’৮৯-এর ৩১টি বছর পর সুইডেনের ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলি কেবলই হেপাটাইটিস সি-ময়? কারণটা পরিষ্কার। মানুষ তার সভ্যতার স্থায়িত্বের জন্য হুমকি হিসেবে যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছে, তার অন্যতম হেপাটাইটিস সি ও বি ভাইরাস। এ কারণেই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি গোল হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস আর পাশাপাশি লিভার ক্যানসারকে ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। বলা বাহুল্য বিশ্বজুড়ে লিভার ক্যানসারের কারণে গোল্ড আর সিলভার মেডেল দুটিও হেপাটাইটিস সি আর বি ভাইরাসই ভাগাভাগি করে নিয়েছে।বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস সি ও বি ভাইরাস সম্পর্কে আরো বেশি সচেতনতা সৃষ্টি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে হেপাটোলজির পিঠে তকমাটা আরেকটু জোরেশোরে সেঁটে দেয়া আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার আওতায় এনে মানবজাতির জন্য একটি সুস্থ ও টেকসই আগামী নিশ্চিত করার তাগিদ থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এবারের নোবেল। আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করতে গিয়ে নোবেল কমিটির প্রতিনিধির কণ্ঠেও ছিল এমনই সুর।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে কোথায় দাঁড়িয়ে এই বাংলাদেশ? প্রশ্নটা যদি দশটা বছর আগে করা হতো, তাহলে উত্তরটা হতো এক কথায় এবং সংক্ষিপ্ত- কোথাও না। একজন প্রজ্ঞাবান নেত্রীর যুগস্পর্শী টানা নেতৃত্বের পটভূমিতে আমরা এখন সেই জায়গা থেকে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছি। ২০০৯-এ যেদিন শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন পুরো দেশে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই হেপাটোলজির একটিমাত্র বিশেষায়িত বিভাগ ছিল। অথচ আজ দেশের প্রায় ২০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিভার বিশেষজ্ঞরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজও খুলেছে লিভার বিশেষজ্ঞ তৈরির কারখানা।

সরকারি উদ্যোগে হেপাটাইটিস সি’র লাখ টাকা দামের ওষুধ আমাদের রোগীরা বিনা মূল্যে পেতেন এই সেদিনও, করোনার ঝাপটাটা এসে লাগার আগ পর্যন্ত। আবারো শুরু হতে যাচ্ছে এই সেবাটি, সামনেই। হেপাটাইটিস নির্মূলে সরকার অনুমোদন করেছে একটি অপারেশনাল প্ল্যানও। করোনার আগ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে হেপাটাইটিস সি ও বি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রতিবছর ব্লুমবার্গের জন্মদিনে ২৮ জুলাই সারা বিশ্বে উদ্‌যাপিত হয় ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত আঙুলে গোনা কটি দিবসের মধ্যে অন্যতম এটি। দিবসটি উদ্‌যাপিত হয় বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রযোজনায়। প্রতিবছর এই দিবস উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই ২০০৯ আর ২০২০-এর বাংলাদেশে আর দশটি খাতের মতো হেপাটোলজিতেও যোজন যোজনের ফারাক।

আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞরা সরকারের এত সব সাধু উদ্যোগের কৃতজ্ঞতায় কাজ  করে চলেছেন নিরলসভাবে। এ দেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে লিভারবিষয়ক একাধিক টেক্সট বুক। প্রকাশক নামকরা সব আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা। প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালও। আর ‘ন্যাসভ্যাক’-এর মতো হেপাটাইটিস বির নতুন ওষুধের উদ্ভাবনীতেও মিশে আছে বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের নাম।এই করোনাকালে করোনার তাণ্ডবে একটা সময়ে বিপর্যস্ত ছিল যখন গোটা দেশের বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা, তখন দেশের অর্ধশতাধিক লিভার বিশেষজ্ঞ তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরগুলো দেশের দশের জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিশেষায়িত সেবা পৌঁছে দেয়ার নিঃস্বার্থ আগ্রহে। সামনে সুদূর রামপালের লিভার রোগীরা সারা দেশের সেরা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে লিভার রোগের পরামর্শ পাবেন ‘আমার গ্রাম’ আর ‘ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দি লিভার বাংলাদেশ’-এর সমন্বিত উদ্যোগে।

দেশে লিভার চিকিৎসার আধুনিকায়নেও অবদান রাখার চেষ্টা আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞদের নিরন্তর। লিভারের আধুনিকতম যত চিকিৎসা- লিভার ক্যানসারের জন্য ট্রান্স-আর্টারিয়াল কেমোঅ্যাম্বোলাইজেশন কিংবা লিভার সিরোসিসে অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেমসেল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন এখন সম্ভব বাংলাদেশেই। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ‘মুজিব প্রটোকল’। লিভার ফেইলিওরের চিকিৎসায় এ বছর এ দেশে শুরু হয়েছে প্লাজমা এক্সচেঞ্জ। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে দেশের কৃতজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞরা নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতিটির নামকরণ করেছেন জাতির পিতার নামে- ‘মুজিব প্রটোকল’। আর তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগে এ নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।এই যে এত অর্জন আর একজন মমতাময়ী নেত্রীর এত আশীর্বাদ, এরপরও কোথায় যেন একটা শূন্যতা। একটা না থাকার বেদনা দেশের কোটি লিভার রোগীর লিভারের দহন! প্রধানমন্ত্রী স্নেহের পরশে আর দূরদর্শিতায় হেপাটোলজি আজ এ দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি স্বতন্ত্র স্পেশিয়ালটি। কিন্তু এখনো এ দেশে লিভারের রোগীদের চিকিৎসা আর লিভার রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশেষায়িত হেপাটোলজি ইনস্টিটিউট অনুপস্থিত।

নোবেলের কল্যাণে এই করোনাকালে কোভিডকে একটু হলেও পাশে সরিয়ে শিরোনামে যখন হেপাটোলজি, এমনি একটা ইনস্টিটিউটের প্রত্যাশাটা তখন আরেকটু বেশি। তবে প্রত্যাশার পেছনে প্রশ্রয়টাও যে কম না! এই ইনস্টিটিউটটি প্রতিষ্ঠার জন্য অনুশাসন রয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর। প্রত্যাশার পারদ যখন ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, সংগত কারণেই প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনাটাও এখন খুবই প্রবল।

লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দি লিভার বাংলাদেশ

You might also like