ভ্যাকসিন নিয়ে কেমন আছি
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
‘ভ্যাকসিন আসবে নাকি আসে না’- বাংলাদেশ এখন ভ্যাকসিনের এই পর্বটি পার করে দ্বিতীয় পর্বে পা রেখেছে।ভ্যাকসিন এসেছে,শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন দেয়াও।দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে যারা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন তাদের দিকে।ভ্যাকসিনের সাইড অ্যাফেক্ট (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) নিয়ে ক’দিন ধরে কথা বলা হয়েছে আর ফেসবুকে ছড়ানো হয়েছে যত গুজব তার কোনো ইয়াত্তা নেই। গুজব ছড়িয়ে যারা মানুষকে ভ্যাকসিনবিমুখ করে তোলায় নিজেদের পায়ের ঘাম মাথায় তুলছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছুটা হলেও সিদ্ধি যে হয়েছে তাও অস্বীকার করার জো নেই।মানুষের মনের গভীরে কোথায় যেন একটা খুঁত খুঁতে ভাব তারা ঠিকই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।যে দেশে মানুষ একসময় ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন ডে’তে ঈদের মতো উৎসবমুখর পরিবেশে শিশুদের টিকা দিত, এখনও যারা তাদের ছয় সপ্তার নবজাতক শিশুকে টিকা দেয়ার জন্য নিয়ে যায় টিকাদান কেন্দ্রে কী প্রচণ্ড আগ্রহে, তাদের মনে টিকা নিয়ে সংশয় ঢুকিয়ে দেয়াটা সোজা নয়। অথচ সেই অসম্ভবও কিছুটা হলেও সম্ভব করেছে এসব দূরাত্মা।
মাত্রই ভ্যাকসিন নিয়ে নিজ কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম।দুদিন আগে হঠাৎ করেই দিল্লি যেতে হয়েছিল।ওখানে গণহত্যার ওপর একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেয়ার ব্যাপার ছিল। যাওয়ার আগেই জানতে পেরেছিলাম ২৮ তারিখ ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছি আমি আর নুজহাত। দেরি করিনি এক মুহূর্তও।গতকাল রাতে সেমিনার শেষে হোটেলে ফিরতে ১১টা বেজেছে। ভোরেই ধরেছি ফিরতি ফ্লাইট। দিল্লির শীত কিংবা খুব ভোরের ফ্লাইট ধরতে গভীর রাতে বিমানবন্দর যাত্রা- না বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কোনো কিছুই।
কানাডায় যখন প্রথম ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আমাদের কলিগরা, আর আমেরিকায় যখন ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজটি নেয়ার তারিখ ভ্যাকসিনের অভাবে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে সাত-সাত দিন, সেখানে পৃথিবীর কত উন্নত আর বিত্তশালী দেশের ফ্রন্টলাইনারদের আগে আমার প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছেন আর আমরা সে সুযোগ হেলায় হারাব, এমন বোকা আমি বা নুজহাত কেউই নয়। সে কারণেই বিমানবন্দর থেকে সোজা বিএসএমএমইউয়ের সদ্যনির্মিত মেডিকেল কনভেনশন সেন্টারে যাওয়া, যেখানে বসানো হয়েছে কোভিড ভ্যাকসিন দেয়ার মহাযজ্ঞ।
ভ্যাকসিন নিয়ে এসে হাতের কাজগুলো সেরেই এই লেখাটি লিখতে বসা। না ভ্যাকসিন নিয়ে আমার সমস্যা হয়নি এতটুকুও। সমস্যা হয়নি নুজহাতেরও। আমরা দুজনই ভ্যাকসিন নিয়েছি, উপস্থিত সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি, অনুরোধ করেছি দেশবাসীকে জানিয়ে দিন ভ্যাকসিনে বিপত্তি নেই, এতে শুধুই মুক্তি। তারপর হাতের কাজটুকু সেরেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে লেখাটি লিখতে বসা। কারণ শুধু আমি ভ্যাকসিন নিয়ে ভালো থাকলেই চলবে না, ভালো থাকতে হবে দেশের প্রতিটি মানুষকে। তাদের জানতে হবে কোভিশিল্ড কতটা নিরাপদ। লেখাটি একটু পরে ই-মেইল করেই ছুটবো আমার ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেম্বারে।
দুদিন দিল্লিতে থাকায় রোগীর চাপ আজ থাকবে যথেষ্টই।অন্যান্য যেকোনো দিনের চেয়েও অনেক বেশি।চেম্বার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোন করে জানিয়েও দিয়েছে তা।তবে তা নিয়েও আমার কোনো শঙ্কা নেই।কারণ শরীরই বলছে সে পুরো ফিট। জ্বরজারি তো বহুদূরের কথা, ভ্যাকসিন নেয়ার জায়গাটাতে কোনো ব্যথাও তো ঠাওর করতে পারছি না। নিশ্চিন্ত মনে তাই আমি আমার পরবর্তী গন্তব্যর দিকে রওনা দিচ্ছি। ফোনে নুজহাত জানাচ্ছে সামান্যতম সমস্যা নেই তারও। সেও যাচ্ছে তার চেম্বারেই খানিক পরই।
যাওয়ার আগে ভ্যাকসিন নেয়ার সময়কার অনুভূতিটা সবার সাথে একটু ভাগাভাগি না করলেই নয়।অনেক কষ্টে চেপেছি চোখের জল। ডবল সার্জিক্যাল মাস্কের কারণে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীদের সেটা বুঝতে না দেয়াটা অবশ্য কিছুটা সহজই হয়েছে। ভ্যাকসিন নেয়ার সময় চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠেছে একজন মহীয়সী নারীর মুখ। প্রাণভরে স্রষ্টার কাছে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছি।তিনি ছিলেন বলেই ফেসবুকে দেশে-দেশে মানুষের ভ্যাকসিন নেয়ার ছবি দেখে কাটবে না আমার সময়, বরং বাংলাদেশের একজন গর্বিত ফ্রন্টলাইনার হিসেবে আমার ভ্যাকসিন নেয়ার ছবিটি ছড়িয়ে পড়বে ইথারে-ইথারে আর জানান দেবে একজন শেখ হাসিনা কীভাবে তার কোটি সন্তানকে আবারও অপারকৃজ্ঞতায় আবদ্ধ করলেন।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।