জুয়েল রাজ-এর বিশুদ্ধ হাহাকার : আমার কিছু কথা
ময়নূর রহমান বাবুল
সত্যবাণী
আজ দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে আমার টেবিলের উপর ’বিশুদ্ধ হাহাকার’ এর উপস্থিতি।হ্যাঁ, একখানা কবিতার বই, নাম ’বিশুদ্ধ হাহাকার’। কবিতা সংখ্যা ৬৪ এবং মোট ৭১ পৃষ্ঠার এই কাব্যখানি আমাকে পড়ার জন্য দিয়েছেন এর রচয়িতা কবি ও সাংবাদিক জুয়েল রাজ। যদিও ব্যাক্তিগত ভাবে কবি জুয়েল রাজ আমার কাছে একজন সফল সাংবাদিক হিসাবে বেশী প্রিয়। বিশুদ্ধ হাহাকার আমাকে ছুঁয়ে যাবার আগে অর্থাৎ এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা সোসাল মিডিয়ায় জুয়েল রাজের কবিতা পড়েছি। তাঁর কিছু কিছু কবিতার সাথে আমার পঠন আলিঙ্গন হয়েছে। যেমন হয়েছে তাঁর বিভিন্ন সংবাদ, প্রতিবেদন ইত্যাদির সাথে।
গ্রন্থিত হিসাবে তাঁর বিভিন্ন সময়ের লেখা কবিতাগুলো নিয়ে বিশুদ্ধ হাহাকারই জুয়েল রাজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এ কবিতা গ্রন্থের প্রথম দিকে ছোট্ট করে এক পৃষ্ঠার একটি ভ‚মিকা আছে। যেখানে কবি নিজেই লিখেছেন ’চাপাতির চেয়ে কবিতা অবশ্যই উত্তম’। আমি এর সাথে যোগ করে বলতে চাই ’চাপাতির চেয়ে কবিতা আরো বেশী ধারালো’।
এই ক’লাইনের ছোট্ট ভ‚মিকায় আরো আছে। তিনি লিখেছেন ’কবিতা আমার কাছে অহির মতো। সেটা ভুল, শুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। বোধগম্য অথবা দূর্বোধ্য, এই বিষয়ে সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু কবিতা মিথ্যা নয়। কবিতা কবির বোধ ও অনুভ‚তির যুগলবন্দী। সব প্রেমিক যেমন খুনী হয়না, সব কবিতা যেমন গান হয়না, সব কবিও তেমনি কবি হয় না।’
আমার মতে কবির এই মতামত খুবই যথার্থ। সৃষ্টির আদি যুগে মানুষের মধ্যে লেখা পড়ার প্রচলন হওয়ারও আগে মানুষ মুখে যে কথা বা ভাব ছন্দে ছন্দে প্রকাশ করতো, কবিতার প্রচলন তখন থেকেই শুরু। কেউ যেন বলে ছিলেনঃ জিহŸায় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ সমষ্টিই কবিতা। আবার এওতো বলা হয় যে, ভাব প্রকাশের জন্য ছন্দবদ্ধ পংতিমালাই হচ্ছে কবিতা। সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ কখনো কখনো তার ভাব প্রকাশ করতো ছন্দে, সুরে। ছন্দ হলেই যা কবিতা হয় -আর গান হয় সুরে..। নিয়ম ও ব্যয়াকরণ মেনেই কবিতা হয়। একথাটা মানলেও অনেকেরই কিন্তু এই মতামতের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক থাকেনা যখন তিনি কবিতা লিখেন। তা’হলে কি এই ব্যায়াকরণ আর নিয়ম না মানলেই কবিতা হয় না ? কঠিন নিয়মের আবর্তে থেকে অথবা সংজ্ঞা মেনে না লিখলেই কি তাহলে কবিতা হয়না? আমি বলবোঃ হয়। জিহবায় উচ্চারিত শব্দ সমষ্টিইতো কবিতা।
প্রকৃত সংজ্ঞা বা ব্যায়াকরণ অনুযায়ী কবিতা বিচার করার যোগ্যতা অমার নাই। আমি এমনটা প্রয়োজনও মনে করি না। আমি যদি আমার মতো করে এই বিশুদ্ধ হাহাকার-এর কবিতাগুলো নিয়ে বলতে চাই তা হলে এক কথায় বলবোঃ ভালো। অবশ্য দুই অক্ষরের এই ’ভালো’ শব্দটা আমার কাছে খুবই ব্যাপক -অনেক বড়।
গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ধর্মগ্রন্থ। আর বইয়ের শেষ পৃষ্ঠার কাবতাটির নাম ’চুতমারানীর পোলা দেশ ছাড়ুমনা’। মধ্যখানে যে ৬২টি কবিতা আছে এবং এই গ্রন্থখানি আমাদেরকে কী ম্যাসেজ দিতে চায় তা আশাকরি আর ভাবতে হবেনা। খুব কঠোরতার সাথে নিয়ম বা ব্যায়াকরণ মেনে না হোক, অন্তত বক্তব্য বা ম্যাসেজতো পৌঁছে যাবে আমাদের কর্ণ-কুহরে। আর এটাইতো চাই। তাই নয় কি ?
বন্ধকী মন নামের মাত্র চার লাইনের একটা কবিতা এ বইয়ের ১০ম পৃষ্ঠায়। ’দারুণ অভাবে, বানিয়ার দোকানে/ যেমন বন্ধক দেয় নারী বিয়ের মতিহার।/ আমার জীবনখানি তোমার গদিতে বন্ধক রেখে,/ ক্যামানে করি মনের কারবার।’
কবিতার নাম -হাসরের ময়দান। ’দুঃখ লিখে রাখি নিয়তির পৃষ্টায়/ জীবন সব জমা হয় ধর্মগ্রন্থে/ চিত্রগুপ্তের খাতা জুড়ে/ লিখে শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদ।/ মুনিকির নাকিরের/ খাতা ভরে আছে/ শুধু প্রেমের কাহিনি।/ শুন্য হাসরের ময়দান।/
বিশুদ্ধ হাহাকার নামে যে কবিতাটি আছে। তার শেষ দুটো লাইন এরকম ঃ সব জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি আমি/ চার পাশে ঘিরে আছে বিশুদ্ধ হাহকার।/ হ্যাঁ, হাহাকার! কিন্তু তাও আবার বিশুদ্ধ! কবির ভাবনাকে সাধুবাদ দিতেই হয়।
বাউলামি সুখ কবিতাটি এরকম; ’আমি ভুলিনা তারে/ না, সে আমারে ভুলে/ ঘুরেফিরে ফিরে আসি/ দুজনেই দুজনের কাছে/ আমিও ফেরাই তারে/ সেও ফেরায় বারে বারে।/ ফিরে গিয়ে মনে হয়,/ ফেলে এসেছি কিছু তার কাছে।/ আমিও খুঁজিনা তারে/ না, সে আমারে খুঁজে/ নীরবে বুকের ভিতর/ নিরবধি দু’জনেই ধরে তবু রাখে।/ নগর ভ্রমিয়া খুঁজি বাউলামি সুখ/ বুকের ভিতরে সখি এ কোন অসুখ।’
বইয়ের ১৭ পৃষ্ঠায় মাত্র চার লাইনে ’নষ্ট সময়ে বেঁচে থাকা’ কবিতাটি দেখুন কীভাবে পাঠককে ভাবায়। -’নষ্ট নগর নষ্ট রাত/ পুড়ে যায় চারপাশ/ নষ্ট সময়ে বেঁচে থাকি/ তোমার হাতে রেখে হাত।’আমার মতো অনেকেই হয়তো ভাবেন -কবি সব সময়ই বিদ্রোহী, প্রতিবাদী। কবি কম্প্রোমাইজ করতে জানেন না। আপোশকামিতা যেন কোন কবির ধাতে না থাকে। কিন্তু কথা থাকতে পারে, তা’হলে প্রেমে ? এখানেও বিদ্রোহী হলে চলবে? কিন্তু বিপ্লবীর জীবন ইতিহাসেওতো আমরা প্রেম দেখি ! দেখি না ?
সুুধাংশু যাবে না -অনেকগুলো কবিতার মধ্যে আরেকটি ভিন্ন মেজাজের কবিতা। ’আমি শুধাংশু না পরাজিত সৈনিকের মতো আমি কোথাও যাব না।/ ধুলোয় লোটাক মাটির মূর্তি/ আমার বিশ্বাস এই বুকে।/ সিঁদূরের কৌটা, জমির দলিল সব পুড়ে যাক/ … … অনঢ় পাথর হব এক চুল ছাড়ব না।/ এই মাটি ছেড়ে পালাব না।’ – এখানে যে শুধু দেশ প্রেম, তা কিন্তু নয়। সাহস, প্রতিবাদী মনোভাব এবং এর সাহসী উচ্চারণও বটে। নিজের অধিকার আদায় কিংবা টিকিয়ে রাখাই প্রকৃত সাহসী মানুষের কাজ। আর এটাই করা উচিৎ -এ শপথেই স্থির থাকা, অবিচল থাকা, দৃঢ় থাকা উচিৎ।
কবিগন সব সময়ই কি সাহসী হন ? সাহসী থাকেন ? হতাশা কিংবা ব্যর্থতা কতটুকু তাদেরকে দংশন করে? ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে কবি কি কখনো সব গুঁটিয়ে ঘাটিয়ে বসে থাকেন, অথবা পালিয়ে বেড়ান ? কেউ কেউ হয়তো বলবেন ঃ না, কবিরা আরো জ্বলে উঠেন, জেগে উঠেন। হয়তোবা তাই- কিন্তু আমাদের আলোচ্য কবি জুয়েল রাজ এখানে তাঁর ’ভালোবেসে ভুল করিনি’ শিরোনামের ১৮ লাইনের একটি কবিতার প্রথম চার লাইনে দেখি ’ইচ্চেরা সব শবের মিছিল/ স্বপ্ন ভূমি শ্মশান।/ ভালবাসা বেঁচে থাকে/ বেঁচে থাকে টান।’
জুয়েল রাজ সপরিবারে বাস করেন যুক্তরাজ্যে। সহজ ভাষায় যাকে আমরা প্রবাসি বলতে পারি। অতএব দেশ ছেড়ে আসা প্রবাসে বিদেশে থাকা একজন কবি কোন না কোন ভাবে তার কথায়, তার লেখায়, আচরণে এমনটা প্রকাশ করবেনই। সে তার জ্ঞাতে হোক বা অজ্ঞাতে হোক। অথবা অন্যমনস্কতায়। আর আমরা যদি তার বিশুদ্ধ হাহাকার কাব্যগ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠায় ’অপেক্ষা শহর জুড়ে’ নামক কবিতাটির কয়েকটা লাইন দেখি- ’ডাকছে শহর/ ডাকছে আমায়/ ফেলে আসা গাঁ/ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা/ একলা আমার মা … …’ ভীষণ ভীষণ ভাবে অন্য রকম ভালো লাগা একটি কবিতা। এরকম ভালোলাগা প্রায় প্রত্যেকটি কবিতাই। তাছাড়াও ’পরবাস, বাউলনামা, মায়া, বুকের পাটা, আমি আর ভগবান, বিশুদ্ধ অনল, ডুবে যায় সপ্তডিঙ্গা’ নামের কবিতাগুলো বইটির ব্যঞ্জনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশুদ্ধ হাহাকার পড়তে পড়তে আমার কাছে ঠিক তেমনটিই মনে হয়েছে। অনেক ভালো কিছু কবিতার সমষ্টি, অনেক ভালো কিছু কবিতার গ্রন্থিতরূপ বিশুদ্ধ হাহাকার।
বিশুদ্ধ হাহাকার প্রকাশ করেছেন ’চৈতন্য’ থেকে মো. জাহিদুল হক চৌধুরী রাজীব। জিন্দাবাজার,সিলেট।ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে।ঝকঝকে ছাপা,সুন্দর বাঁধাই কিন্তু বানান ভুলের কষ্টটা ভুলা যায়না। প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত।মুল্য-১৫০ টাকা।গ্রন্থখানি লেখক উৎসর্গ করেছেন তার প্রিয় দুই বন্ধু সুসময় দু:সময়ের সহযাত্রী উজ্জল দাশ ও আ স ম মাসুমকে।
অত্যন্ত সুখপাঠ্য এই গ্রন্থখানির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করুক এটাই আমার প্রত্যাশা।