গৌরকিশোর ঘোষ : জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা
দিলীপ মজুমদার
আবুল ফজলের প্রথম চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অকপটে জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের আধখানায় সাহিত্যের আলো পড়ে নি । এই ‘আধখানা’ বলতে তিনি মুসলমান জনজীবনকে বুঝিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের উত্তর পেয়ে আবুল ফজল কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে উঠে দ্বিতীয় চিঠিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ উথ্থাপন করে লিখলেন , “শুনেছি ‘গল্পগুচ্ছে’র অনবদ্য গল্পগুলি শিলাইদহে আপনাদের জমিদারিতে বসেই লেখা , শিলাইদহের মুসলমান প্রজামণ্ডলীর মধ্যে আপনার কি আসন তা শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর প্রবন্ধ না পড়েও আমরা আন্দাজ করতে পারি ; অথচ এদের জীবন আপনার কোন সাহিত্য প্রচেষ্টার উপাদান হতে পারল না ।এ চিঠির উত্তর রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত দিতে পারেন নি । অনতিকাল পরেই তাঁর মৃত্যু হয় ।অভিযোগ যে সত্য তার ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম উত্তরের মধ্যে নিহিত আছে । তিনি বলেছিলেন , ‘আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা ওই সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হলে সাহিত্যের পথ দিয়ে জানতে হবে , এর প্রয়োজন আমি বিশেষভাবে অনুভব করি ।
অথচ আশ্চর্ষের বিষয় হল রবীন্দ্রনাথের পরে কোন বাঙালি ‘হিন্দু’ লেখক মুসলমান জনজীবনকে তেমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি তাঁদের সাহিত্যকর্মে । কোন জনজীবনকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলার প্রাথমিক শর্ত সে জীবনকে ঠিকঠিক চেনা ও জানা । জীবনে জীবন যোগ না করলে চেনা—জানা সম্ভব নয় । ভাসা ভাসা চেনা-জানা দিয়ে সাহিত্য যে রচিত হয় নি , তা নয় । একটু মন দিয়ে পড়লে তাদের ফাঁক ও ফাঁকি ধরা পড়ে যায় । গবেষক শেখ মঈদুল ইসলাম তাঁর ‘ গৌরকিশোর ঘোষ : মুসলিম জীবন ও অভিমানস’ বইতে এদিকের উপর আলোকপাত করেছেন ।বাংলা দেশের আধখানায়’ তিনি ফেলতে চেয়েছিলেন সাহিত্যের আলো । তাঁর ট্রিলজি ‘দেশ মাটি মানুষ’ই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ । ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ , ‘প্রেম নেই’ , ‘প্রতিবেশী’ পড়ে আমি লজ্জায় অধোবদন । কাঁথির খাগড়াবনি গ্রামে আমার বাড়ি । আমার গ্রামে, আমার বাড়ির পাশে মুসলমানরা বসবাস করে । বহুকাল ধরে । আমরা তাদের কাজে লাগি ,তারা আমাদের কাজে লাগে । বিকেলবেলা একসঙ্গে খেলাধুলো , গল্পগুজব করি । অথচ তাদের অন্তরঙ্গভাবে চিনি না । তারাও চেনে না আমাদের । মুসলমানদের সঙ্গে সহজ সামাজিকতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি হিন্দুদের । সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এটাই সবচেয়ে বড় বাধা । রাজনীতি সে ঐক্য গড়ে তুলতে পারে না , পরিবর্তে বিষিয়ে দেয় , জটিল করে তোলে ।
গৌরকিশোর ঘোষ মুসলমান জনজীবনকে চিনেছিলেন অন্তরঙ্গ মেলামেশার মধ্য দিয়ে । আমাদের অনেক লেখকেরই মুসলমান বন্ধু আছে , কিন্তু সে সব মুসলমান ইংরেজি-জানা , অভিজাত মুসলমান । তারা কেউ দাউদ , চাঁদবিবি , বাইজন্দি ,সবুরালি , জালালুদ্দিন , নয়মোন , সইফুন , ইয়াকুবদের মতো গ্রাম্য ও অনভিজাত নয় । তাদের বিশ্বাস , তাদের সংস্কার , তাদের আচরণ গৌরকিশোর ফুটিয়ে তুলেছেন দুধের সঙ্গে জল না মিশিয়েই । এরা কোরানকে যেমন মানে , তেমনি মানে তফসির , এজমা কিয়াস ফেকা এবং মোল্লা-মৌলবীদের বচনকে । সাধারণ হিন্দুরা যেমন মানে পুরাণের গাল-গল্পকে ।গৌরকিশোর মুসলমান সমাজের অসহায়তা , দৈবনির্ভরতা যেমন দেখিয়েছেন , তেমনি ধীরবিলম্বিত পরিবর্তনের রূপরেখাও অঙ্কন করেছেন চমৎকারভাবে । তাই তো মৌলবী দীন মহম্মদ দৌলতপুরীর মতো মানুষেরা ‘আংরেজি পঢ়নেওলা’ মুসলমানদের সহ্য করতে পারেন না । কারণ তারা মৌলবী সাহেবকে ‘নায়েব নবী ‘ বলে ঠাট্টা করে এবং ‘বলে কি না ফেকা শাস্ত্রের কচকচিতে মজহরী লড়াই উসকে দিয়ে মৌলবী মোল্লারা মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং নিজেদের গোশ-রুটি প্রচুর পরিমাণে পাকিয়ে নেবার চেষ্টা করছে ।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।