আমেরিকান রাষ্ট্র ও সমাজের গভীর ক্ষত
রায়হান আহমেদ তপাদার
শুরু থেকেই আমেরিকায় বহু লোকের বাস।প্রথমে আমেরিকায় বাস করতো শুধু স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানরা।পরে ইউরোপীয় বহু দেশ থেকে লোকজন যাওয়ার শুরু করে, আর এরই মধ্যে আফ্রিকা থেকে বহু কৃষ্ণাঙ্গকে নিয়ে আনা হয়।আবার ১৮০০ শতকের শেষ দিক থেকে প্রচুর চীনা লোকজন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে হিজরত করে কাজের খোজে।লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকেও বহু লোক সীমানা পাড়ি দিতে থাকে।১৯৬৫ সালে এদেশে অভিবাসন আইন পরিবর্তনের পর সারা বিশ্ব থেকে, বিশেষত আরব, দক্ষিন এশিয়, ফিলিপিনো, ইন্দোনেশিয়ান, লাতিন আমেরিকার ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে বহু লোক আমেরিকায় স্থায়ী ভাবে বসতি গড়ে।১৯৯০ সালের দিকে অভিবাসন আইন কঠোর করে দেয়ার আগে আমেরিকায় চলে যাওয়াটা বেশী কঠিন ছিল না। যাহোক, বর্তমানে আমেরিকা যেহেতু বহু বর্ণের-গোষ্ঠীর দেশ, তাই এখানে এই শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা অতটা প্রকট ও প্রস্ফুটিত নয়। তারপরও এদেশেএর ইতিহাসে কালোদের নাগরিক অধিকার আদায় নিয়ে বহু দাঙ্গা-হাঙ্গামা-যুদ্ধ হয়েছে এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ হত্যা করার পর আমেরিকার বর্ণবাদী চেহারা আরেকবার উন্মোচিত হলো। কয়েক শতাব্দী পরেও বর্ণবাদী নির্যাতনের রক্তমাখা আমেরিকা বদলায়নি।প্রতিবছর ১২ অক্টোবর যে আমেরিকানরা সাড়ম্বরে ‘কলম্বাস দিবস’ পালন করেন, সেদিনই বর্ণবাদের প্রথম পেরেক ঠোকা হয় মহাদেশটির মাটিতে।১৪৯২ সালের প্রথম অভিযাত্রী হিসেবে কলম্বাস এসে তছনছ করেন স্থানীয় মানুষদের সাজানো জীবন। তারপর একে একে স্পেনীয়, ইংরেজ,ফরাসি,পর্তুগিজ দখলদার কবলিত হয় আটলান্টিকের ওপাশের উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা।
সাম্প্রতিক ফ্লয়েড হত্যা থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদ এখন কেবল বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন বা হত্যার বিচার দাবি আন্দোলনে থেমে নেই। এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘বহু বছর ধরে এ পরিস্থিতি চলছে। কোনো কিছুই বদলায়নি। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে কিছু হবে না। সাধারণ মানুষের জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা পরিবর্তন চাই। এভাবে আর চলতে পারে না। আমরাও মানুষ, আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে।’ মার্কিন গণমাধ্যম ‘দ্য হিল’এ বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকেই এমন কথাই বলছেন। প্রতিবাদকারী কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আর্থিক মন্দার প্রভাবে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গরাও। বিশেষ করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে যেসব মার্কিনি নানাভাবে বিপর্যস্ত, বেকার ও হতাশায় ভোগছেন তারাও এই আন্দোলনের স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়াও চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়েছে সঙ্গী হয় বামপন্থী, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট উগ্র ও সহিংস অ্যান্টিফাসহ বিভিন্নগোষ্ঠী। আন্দোলন- কারীদের দমাতে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট মারা হচ্ছে। ৪,১০০ জন আন্দোলনকারীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের শিকার হয়েছেন ডজনখানেক সাংবাদিক। অনেক সাংবাদিক পুলিশের নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের ২৫ মে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার মিনেসোটায় পুলিশের নিশংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারায় জর্জ ফ্লয়েড নামে ৪৬ বছর বয়সি এক আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ। শ্বাসরোধ করে ফ্লয়েড হত্যার ভিডিও ফুটেজ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এই নিয়ে মিনেসোটায় ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়।
২০১৪ সালের ৯ আগস্টে মিসৌরির ফার্গুসনে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসনের গুলিতে প্রাণ হারায় মাইকেল ব্রাউন নামে ১৮ বছর বয়সি এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ। বাদানুবাদের জেরে ওই পুলিশ অফিসার ব্রাউনকে গুলি করে। এই ঘটনার পর ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ আন্দোলনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভে একজন মারা যায়, কয়েকশ আহত হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়। ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিলে আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলাইনার নর্থ চার্লসটনের ওয়াল্টার স্কট নামের ৫০ বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার মাইকেল শ্লোগারের পিঠে তিনটি গুলি করে হত্যা করে। ২০১৭ সালে বিচার ওই অফিসারের বিশ বছরের কারাদ- হয় এবং স্কটের পরিবারকে ৬৫ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় নর্থ চার্লসটন কর্তৃপক্ষ। একইভাবে ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিলে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে পুলিশের নিপীড়নে কারাগারে আত্মহত্যা করে সান্ড্রা ব্ল্যান্ড নামে ২৮ বছরের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী। এর প্রতিবাদে ‘#সেহারনেম’ নামে আরেকটি সামাজিক আন্দোল গড়ে তোলার মাধ্যমে মার্কিন পুলিশের কাছে কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সে চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। ডালাসের ফোর্থ ওয়ার্থে ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার অ্যারন ডিন আতাতিয়ানা জেফারসন নামে ২৮ বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ৮ বার গুলি করে হত্যা করে। ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এখনো তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। লুইভিলের কেন্টাকিতে ১৩ মার্চ ২০২০ সালে ব্রেওনা টেলর নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসা বিষয়ক প্রকৌশলীকে স্বীয় ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ কর্তৃক আতাতিয়ানার মতো আটবার গুলি করে হত্যা করা হয়।
ফ্লয়েড হত্যার মতোই পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার আরেক নিশংস ঘটনা ঘটে নিউইয়ার্কে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মাসে। ওই সময়ও পুলিশ এরিক গার্নারকে খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করছে বলে সন্দেহে করে গ্রেফতার করার পর গলা টিপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। অন্তিম মুহূর্তে গার্নার বারবার কান্নাজড়িত গলায় আকুতি করেছিল, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। অন্তিম মুহূর্তে জর্জ ফ্লয়েড যেমন বলেছিল। চলমান বিক্ষোভে ফ্লয়েডের শেষ বাক্য আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। এই শ্লোগান গোটা মার্কিন মূলুকে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও দারিদ্র্যে কশাঘাত থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার মূলমন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ঠিক এমন কথাই বলছেন বিশ্লেষকগণ। বিশ্লেষকগণ আরও বলছেন, মার্কিন মুলুকে চলমান বিক্ষোভকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের চূড়ান্ত স্ফুরণ বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক করনেল ওয়েস্ট বলেন, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা, সম্পদ ও সম্মান ভাগাভাগি করতে হলে অহিংস বিপ্লব বেছে নিতে হবে। না হয়, এমন সহিংসতার আরো বিস্ফোরণ দেখতে হবে।’ সহিংসতা নিরসনে অধ্যাপক ওয়েস্ট বাস্তবভিত্তিক প্রতিষ্ঠানিক সাম্যের বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন। একই স্বরে কথা বলেছেন কিলি ইউনিভার্সিটির ক্রাউড বিহ্যাভিয়ার অ্যান্ড পাবলিক অর্ডার পোলিশিং বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্লিফর্ড স্টট। তিনি বলছেন, ফ্লয়েড হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাটি তৈরি করেছে পুলিশ। কারণ পুলিশ ও কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সেটাই এখানে স্পষ্ট হয়েছে। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য আছে সেখানে এ রকম সংঘাত অনেকটাই অবশ্যম্ভাবী।
চলমান সহিংস বিক্ষোভ ও লুটপাটের অভিঘাত মার্কিন মূলুকের বর্ণবাদী ও বৈষম্যের সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। অতীতেও এমন আন্দোলন হয়েছে কিন্তু বর্ণবাদ ও বৈষম্যে অবসান হয়নি। এবারের আন্দোলনের ফলে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে কি না, সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যে আমেরিকাকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, অস্ত্র ও বোমাবাজির জন্য সমালোচকরা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে,সে আমেরিকা নিজের দেশে সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও জুলুমকারী। আমেরিকার মুখভরা গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বুলি যে আসলে কতো ঠুনকো ও প্রহসন মূলক, তা প্রমাণিত হয় এইসব বর্বরোচিত সন্ত্রাসী ঘটনায়। তবে, আশার কথা হলো, ভালো ও মন্দের চিরায়ত দ্বন্দ্বের পটভূমি আমেরিকাতেও দৃশ্যমান। পুরো আমেরিকা গর্জে উঠেছে বর্ণবাদী হত্যার বিরুদ্ধে। এতো প্রবল গণবিক্ষোভ আমেরিকায় আগে দেখা যায়নি, যা এখন চলছে মানবিক মানুষের জ্বলন্ত প্রতিবাদের সংক্ষুব্ধ ভাষায়। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড পুরো আমেরিকাকে মুখোমুখি করেছে এক ঐতিহাসিক প্রশ্নের সামনে। তা হলো কলম্বাসের রক্তাক্ত বর্বরোচিত পথে নাকি সুসভ্য মানবিকতার পথে চলবে আমেরিকা? জনগণ এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বর্ণবাদী হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সরবে পথে নেমেছেন। তারাই নির্ধারণ করবেন আমেরিকার চরিত্র এবং সেটা যে বর্ণবাদী বর্বরদের ধ্বংস ও পরাজিত করেই রচিত হবে, ইতিহাস সে সমর্থনই জ্ঞাপন করে। কেননা, শেষ বিচারে মানুষ ও মানবতারই জয় হয়।আমেরিকাতেও তাই হবে বর্ণবাদ ও সন্ত্রাসবাদের চূড়ান্ত অবসানের মাধ্যমে।লেখক ও কলামিস্ট