করোনাকালে অন্যরকম ঈদ
রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। পৃথিবীতে বসবাসরত প্রত্যেক জাতির মানুষের মধ্যে বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে উৎসবের রেওয়াজ প্রাচীনকাল থেকেই।ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে স্বজন আর বন্ধুদের মিলনমেলা, হৈ-হুল্লোড়, ঘুরে বেড়ানো। ঈদ মানে কোলাকুলি, করমর্দন। ঈদ মানে প্রতিবেশীদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা দেওয়া। নাড়ির টানে গ্রামে গিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে একত্র হওয়া। নতুন জামাকাপড় পরা। কিন্তু এবার সেই অনাবিল আনন্দের আবহ নেই। খুশির জোয়ারও নেই। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। এমন অবস্থায় দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর।দীর্ঘ মাসজুড়ে সিয়াম সাধনা ও কঠোর ইবাদত-আরাধনার পর বহুল প্রতীক্ষিত ঈদুল ফিতর দোরগোড়ায়। রোজার মাস সাঙ্গ হলো। এলো ঈদুল ফিতর তথা সর্বজনীন ঈদোৎসব। আলোয় ভেসে যাওয়া এই দিনগুলোতেও যেন বিষণ্ণতার মেঘ ঘিরে আছে আমাদের। ভয়ংকর কালো এই করুণ করোনা কাল। বাতাসে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ যেন বয়ে নিয়ে আসে আগরবাতির গন্ধ। সারা পৃথিবী যখন মানুষের জন্য মৃত্যু অববাহিকা, সেই সময়েই এলো ঈদ। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। হাসি, আনন্দ আর উদযাপনের বার্তা নিয়ে আসে ঈদ। কিন্তু এবার? রোগশোক আর মৃত্যুর রঙে ধূসর এই পৃথিবীতে খুশির ঈদের যেন কোন রঙ নেই। বর্তমানে সারাবিশ্বসহ আমাদের দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি জনিত কারণে মুসল্লিদের জীবন ঝুঁকি বিবেচনা করে এ বছর ঈদগাহ বা খোলা জায়গার পরিবর্তে ঈদের নামাজের জামাত নিকটস্থ মসজিদে আদায় করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া শিশু,বয়োবৃদ্ধ, যে কোন অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
তাছাড়া সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর নির্দেশনা অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে।বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ঈদ অর্থনীতির আকার প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈদ অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির মূল কারণ বাংলাদেশের জিডিপির হার বৃদ্ধি। এছাড়া মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও ঈদ অর্থনীতির আকার বাড়ছে। মূলত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে এক বিশাল মাত্রা যোগ করে। পাশাপাশি দরিদ্রশ্রেণিরাও এসময় তাদের স্বল্প সামর্থ্য থেকেই ঈদ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে। তাই এ দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে ঈদ উৎসব। মূলত রমজান ও কোরবানির ঈদই এ দেশের অর্থনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।উল্লেখ্য যে, করোনাকালে কিছু কিছু শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি নতুন করে পরিচিত হয়েছি। বিশেষ করে এই করোনাকালে লকডাউন, আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলো। তবে প্রতিটি শব্দেই রয়েছে সময়ের দীর্ঘশ্বাস। রয়েছে বেদনা, আতঙ্ক ও নিঃসঙ্গতা। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস নামক ভিলেনের ভয়ে যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সবকিছু। মনের কোণে সামান্য আনন্দটুকুও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চুপ নিঃশব্দ এক পৃথিবীর চেহারা যেন বিশ্ববাসী দেখতে পেল। থমকে গেছে জীবিকা, আর হবেই বা না কেন যেখানে জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়েছে। তবে মানুষ থেমে যেতে শিখেনি। তাই হয়ত করোনা ভয় আস্তে আস্তে মন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। পৃথিবীকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে স্বাভাবিক গতিতে। বহির্বিশ্বের মতো এ দৃশ্য আমাদের দেশেও বিরাজমান। উৎসবের জাতি হিসেবে বাঙালী জাতির পরিচয় নতুন নয়। তবে এই ২০২০ সালে আমাদের দেখতে হয়েছে উৎসবের ভিন্ন রূপ।
করোনাকালে আমরা পার করেছি বাঙালীর সবচেয়ে রঙিন উৎসব পহেলা বৈশাখ। যেখানে পহেলা বৈশাখ আসার আগেই চারদিকে সাজ সাজ রব উঠে যায় সেখানে এবার দেখতে হয়ে পুরোই ভিন্ন রূপ। বাতিল হয়েছে বৈশাখ সংক্রান্ত যাবতীয় উৎসব। যার ফলে একদম ফেকাসে হয়েছিল উৎসবের সব রং। কোথাও লাগেনি কোন রঙের ছটা, বাজেনি কোন গান। ব্যাপারটা এমন ছিল ঘরে বসেও মানুষ মনে হয় গান শুনতে আগ্রহী হয়নি। অজানা এক আতঙ্কে কাটিয়েছে দিন। যার ফলে কোন ফাঁক দিয়ে উৎসবের দিন চলে গেল সে হিসাব মনে হয় কেউ নিতে যায়নি। মরণঘাতী এক ভাইরাস ওলোট-পালট করে দিয়েছে সব। বৈশাখী উৎসবের কিছু দিন পরেই মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয়েছে।সেখানেও একই চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। যে উৎসবে একজন আরেকজনের বাড়িতে যাওয়া, ভাল ভাল খাওয়ায় মেতে ওঠাই ছিল মূল চিত্র সেখানে এবার কেউ যায়নি কারও বাসায়। এমনও হয়েছে উৎসবের দিন অনেক বাড়িতে বাড়তি আয়োজনের দৃশ্যপট ছিল না। এমনকি হাটা চলা ওঠা বসা সবকিছুতেই ছিল সাবধানতা ও আতঙ্কের ছাপ। এমন দৃশ্যও দেখতে হবে ভাবেনি হয়ত কেউ। কিন্তু দেখতে হয়েছে। তবে ওই যে, মানুষ হাল ছাড়ার নয়। সব ছাপিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই যেন মানুষের মূলমন্ত্র।এবারের ঈদুল ফিতরও একই বার্তা বহন করছে। তবে গত ঈদের চেয়ে এবারের ঈদ কিছুটা হলেও আনন্দের যা মানুষের মনে সস্তির বাতাস বইছে।আশা করা যাচ্ছে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে এবার শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমিত থাকবে না। পরিবারে কাছের মানুষরা একে অন্যের বাসায় যাতায়াতও করবে। বিভিন্ন জনের মনোভাব থেকে বোঝা যায় গত রোজার ঈদের মতো একেবারেই ঘরের কোণে থাকবে না অনেকেই।
দিন দিন আক্রান্ত বাড়লেও ভীতি কমে গেছে মানুষের মন থেকে। আর তাই এই সীমিত পরিসরে হলেও আনন্দের ক্ষণ ভাগাভাগি করে নিতে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে।
বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালী জাতি উৎসবের আবেশে ভেসে যেতে অভ্যস্ত। সেখানে এবার যেন বাদ সেধেছে করোনাভাইরাস। শঙ্কা কাটিয়ে এবারের ঈদে সবাই শামিল হলেও মনের এক ধরনের ভয় কিন্তু থেকেই যাবে। বলা যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার এক ঈদ আনন্দ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মাতলেও হুট করেই বেরিয়ে আসবে না কেউ কোন বন্ধুর বাসা থেকে। দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সচেতনতার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর করোনা আক্রান্ত পরিবারে ঈদ বলে তো তেমন কিছুই থাকছে না। সেই সঙ্গে সারাদেশে বিরাজ করছে বন্যা। কিছু কিছু এলাকা তো ঈদের দিনেও থাকবে পানির নিচে। জীবন চালানোই যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে ঈদ আনন্দের কথা ভাবাই যায় না। তাই বলা যায় আনন্দ বেদনার মিশেল এই ঈদ। তারপরেও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। অন্ধকার দিন পেছনে ফেলে আলো আসবেই। আর সে আলোতেই সবাই গাইব জীবনের জয়গান। সেদিনই হয়ত আনন্দের পূর্ণতা ঘটবে। আপাতত সেদিনের অপেক্ষায়।আমরা চাই না শুধু এমন শুভেচ্ছা বিনিময়। এমন পরিস্থিতি এমন ঘরবন্দী ঈদ আর না আসুক মানব জীবনে। তাই এই করোনাকালের ঈদের প্রধান প্রার্থনা হচ্ছে, পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী মানব জীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে পাল্টে দিয়েছে! সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, খুশি-আনন্দের পরিবর্তে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।করোনা মহামারী কেড়ে নিয়েছে মানব মনের সকল খুশি-আনন্দ। প্রতিবছর ঈদ এলে মুসলিম বিশ্ব মেতে উঠে এক অনাবিল স্বর্গীয় আনন্দে আর বিলিয়ে দেয় পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা। প্রবাসীরাও প্রবাসজীবনের শত কষ্ট আর বঞ্চনার মাঝে ঈদের কয়েকটি দিন অন্তত খুঁজে নিত প্রবাসে অবস্থানরত অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিত জনদের সাথে। শেয়ার করতো প্রবাস জীবনের সঞ্চিত ব্যাথা, হালকা করতো নিজেকে।
কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে যখন নিরব নিস্তব্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, দেশে দেশে কারফিউ আর লকডাউন দীর্ঘদিন ধরেই কর্মহীন হয়ে ঘরে বন্দি থাকা প্রবাসীদের এইবারে ঈদ কিভাবে পালন করতে যাচ্ছে তাদের ভাবনার কথা গুলো তুলে ধরার চেষ্টায় কথা বলেছি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির সাথে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ভারাক্রান্ত মনে উদাস হয়ে নিজের রুমে বালিশের সাথে শুয়ে শুয়ে পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রবাসের মাটিতে পরে আছে নিথর দেহখানি কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে দেশে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর কাছে।এক ভাইরাসের কারণে মানবজাতির এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখতে ভালো লাগছে না মোটেই। করোনা আমাদের ঘরবন্দী করে রাখার পাশাপাশি বঞ্চিত করছে একের পর এক আনন্দ–উৎসব থেকে। আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা করাতেও বাধা এই করোনা। ঈদ আনন্দের সব অনুষঙ্গ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে এই করোনা ভাইরাসের কারণে। ঈদে মহাসমারোহে হইচই করে ছুটে বেড়ানো শিশুরাও আজ ঘরবন্দী। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হয়? ঈদ আনন্দের সব অনুষঙ্গ ত্যাগ করেও যদি পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নিত, তাহলে শান্তি পেত মন। অথচ আমরা এখনো ধারণাও করতে পারছি না কবে এই করোনাভাইরাস বিদায় নেবে মানবজাতির কাছ থেকে। তবুও সব আঁধার একসময় ফুরায়। গহীন অরন্যের শেষপ্রান্তে এক চিলতে আলো দেখবার প্রত্যাশা থাকে পথ খুঁজে বেড়ানো মানুষের। অবসাদ, মানসিক চাপ কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ ফিরুক জীবনে। শহর ফিরুক তার নিজস্ব ছন্দে। প্রকৃতি ফিরুক নিজের নিয়মে। আমরা সেই সুদিনের প্রত্যাশায় পথ চেয়ে রই। পৃথিবী থেকে করোনার বিদায়ে মানুষ ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দিত হবে। এবং সেই আনন্দই পৃথিবীর বুকে আসুক দ্রুত, এটা এই করোনা দিনের ঈদ প্রত্যাশা।দূরের, কাছের পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট