জেনোফোবিয়ায় নতুন সংযোজন : করোনাফোবিয়া
দিলীপ মজুমদার
আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের পরে ‘জেনোফোবিয়া’ কথাটা পাক খাচ্ছে খুব। তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে ‘রেসিজম’ বা বর্ণবিদ্বেষ।জানতাম জেনোফোবিয়ার উৎসভূমি গ্রিস।তারা তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করত।অন্যদের তারা ‘বর্বর’ বলত।তাই বর্বরদের ব্যবহার করা হত ‘দাস’ হিসেবে।হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘স্পার্টাকাস’ উপন্যাসে সেই দাসদের অমানুষিক জীবনযাপনের বর্ণনা আছে।আফ্রিকার কালো মানুষেরাও ছিল অচ্ছুৎ।তাদেরও ‘দাস’ করে রাখা হত।হ্যারিয়েট স্টো-র ‘আঙ্কল টমস কেবিন’এ সেই দাসদের জীবন্ত ছবি দেখি।রবীন্দ্রনাথ একটু বোকা লোক ছিলেন বলে ‘আফ্রিকা’ কবিতা লিখেছিলেন।
করোনা সংক্রমণের পটভূমিকায় পৃথিবীর দেশে দেশে একটা নতুন বর্ণবিদ্বেষ শুরু হয়েছে । বোধ হয়,এর সুত্রপাত করেছিলেন আমেরিকার মহামান্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প । ডেট্রয়েটপ্রবাসী আমাদের অরিজিৎ ঘোষ যাঁকে বলে ‘পাগলা দাশু’ ।তখন আমেরিকায় করোনার সংক্রমণ সবে শুরু হয়েছে । ট্রাম্প করোনাকে দেগে দিলেন ‘চিনা ভাইরাস’, ‘উহান ভাইরাস’ বলে।চিনাদের সঙ্গে দেহগত মিল আছে জাপান প্রভৃতি কয়েকটি দেশের মানুষের।তাই ইউরোপের নানা দেশের মানুষেরা চিন-জাপান প্রভৃতি দেশের মানুষকে অপমান-লাঞ্ছনা করতে শুরু করে দিল । তাদের সঙ্গে কথা বন্ধ,আ্যপার্টমেন্ট থেকে তাদের বিদায় নিতে হবে, ক্যাব ড্রাইভার সাড়া দেবে না তাদের ডাকে।ভারতে আবার মুসলিমবিদ্বেষ । উৎস দিল্লির নিজামউদ্দিনের জমায়েত।দুমাস আগে থেকে এটা চলছে, সরকার বিদেশি প্রতিনিধিদের আসার ছাড়পত্র দিয়েছেন ,কিন্তু যেই করোনা সংক্রমণ হল তখন সব দোষ তাদের উপর পড়ল । যেন তারাই ডেকে এনেছে করোনাকে : আয় খোকা আয় ।
উন্নয়নশীল দেশে করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে আর একটা শ্রেণিবিভাগ দেখতে পাচ্ছি : করোনা-আক্রান্ত এবং করোনা-অনাক্রান্ত । কার্ল মার্ক্স বেঁচে থাকলে তাঁর শ্রেণিবিভাগ নিয়ে হয়তো নতুন ভাবনার খোরাক পেতেন । মণিপুরের মেয়েরা এখানকার হাসপাতালে নার্সের চাকরি করত । কোভিদ হাসপাতালেো ডিউটি পড়ত তাদের । তারা রাস্তায় বেরুলে ‘করোনা করোনা ‘ বলে চিৎকার উঠত । নিত্যনিয়ত এই অসম্মান সহ্য না করতে পেরে তারা চলে গেল স্বদেশে । কোন বাড়ির কেউ করোনা আক্রান্ত হলে প্রতিবেশীরা নাগরিকের দায়িত্ব সম্বন্ধে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে সেই বাড়ির দেওয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে দিল ‘কোভিদ-১৯’। আমাদের দেশে প্রাচীনকালে শূদ্রদের ছায়া মাড়ানো ছিল পাপ । সেই নিয়ম ফিরে এল বুঝি বা । কোন মানুষের করোনার সামান্য উপসর্গ দেখা দিলে, টেস্টের আগেই সচেতন নাগরিকরা সতর্ক হতে শুরু করে দিলেন । সেই প্রাচীন ভারতের জল-অচল নীতি । এমনও দেখা গেছে, সামান্য উপসর্গ দেখে বৃদ্ধা মাকে ত্যাগ করে চলে গেছে ছেলে, হাসপাতালের ডাক্তার স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দিতে নারাজ সচেতন স্ত্রী । রাত্রিবেলা হার্ট আ্যাটাক হয়েছে এক বর্ষিয়সী গৃহবধূর । স্বামী চাকরিসুত্রে বাইরে, লকডাউনে আসা সম্ভবও নয় । ঘরে তার মেয়ে । সে মেয়ের চিৎকারে প্রতিবেশীরা সাড়া দিল না কেউ । বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন সেই
মহিলা।কিডনির সমস্যা আছে এক বৃদ্ধের । হাসপাতাল থেকে ডায়ালিসিস করে তিনি বাড়ি ফিরতে দূর থেকে তাঁকে ঘিরে ধরল সচেতন প্রতিবেশীরা, ‘হাসপাতালে কেন ? করোনা নিশ্চয়ই’ ।করোনা নিয়ে ভয়ের কারণ আছে ঠিকই । অদৃশ্য অণুজীবের আশ্চর্য সংক্রমণ ক্ষমতা । সেই ক্ষমতায় আচ্ছন্ন সারা বিশ্ব । নাজেহাল তথাকথিত উন্নত দেশগুলি । কিন্তু ভয় যদি সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে গ্রাস করে ফেলে তাহলে মানুষ কি আর মানুষ থাকে !
সকলের তরে সকলে আমরা’ , এই মানবিক উপলব্ধি মানুষ অর্জন করেছে অনেক অভিজ্ঞতার স্তর পার হয়ে। এটা নিছক নীতিকথা বা আলঙ্কারিক মানবপ্রেম নয় । সে উপলব্ধি করেছে, ‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ, বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে’ । কেন ? কারণ জনসংখ্যা যত বেড়ে্ছে, ততই বেড়েছে পরনির্ভরশীলতা । অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণও আছে । নিত্যপ্রয়োজনী্য সব জিনিস কোন এক বিশেষ দেশে উৎপন্ন হয় না, তার জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয় । গল্পের রবীনসন ক্রশোর মতো দ্বীপাচারী হয়ে বেঁচে থাকা এ যুগের মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব । চাচা কিছুতেই আপন প্রাণ বাঁচাতে পারবে না । সংক্রমিত হবার ভয়ে আমি অন্যের আর্তনাদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম না, আমার অনুরূপ বিপদে তাহলে অন্যদেরও সাহায্যের হাত বাড়াবার প্রশ্ন থাকে না । আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ‘আত্মনির্ভরশীলতা’র বাণী দিচ্ছেন, তা শুনতে ভালো, জাতীয়তাবাদী জিগির হিসেবেও ভালো, ভোটের ময়দানে শ্লোগান হিসেবেও ভালো, কিন্তু বাস্তবে তা airy nothing. কমলি নেহি ছোড়তির মতো করোনাও চটজলদি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না । সে রক্তবীজ । সহজে যাবার নয় । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করোনাকে পাশবালিশ করে নেবার কথা বলেছিলেন । সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সে কথায় । কি ভেবে মুখ্যমন্ত্রী সে কথা বলেছিলেন জানি না । কিন্তু কথাটা বেখাপ্পা হলেও সত্য । করোনা বেশ কিছুদিন থেকে গেলে জীবন-জীবিকা তো স্তব্ধ করে দেওয়া যায় না ।তাই লকডাউনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না । যতটুকু পারা যায় সতর্ক হয়ে আমাদের বাইরে বেরুতে হবেই । আর সেই সঙ্গে আমাদের নিজের স্বার্থে অন্যের পাশে দাঁড়াতেই হবে ।এই কথা খুব জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে । যাঁরা বলতে পারেন, যাঁদের কথা লোকে গুরুত্ব দেবে, সেই বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বড় হতাশ করে । আর কতদিন শীতঘুমে আচ্ছন্ন থাকবেন তাঁরা ?