ডিজিটাল বাংলাদেশের স্থপতি সজীব ওয়াজেদ জয়
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
২৭ জুলাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন। এবারের জন্মদিনটি নিঃসন্দেহে তার জন্য বিশেষ তাৎপর্যবাহী। কারণ এদিন তিনি ৫০-এ পা রাখলেন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই সন্দিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি নিশ্চিই তার ঘটনাবহুল জীবনের অর্জনগুলোকে বিশ্লেষণ করবেন আর অবশিষ্ট জীবনের লক্ষ্যগুলোও নির্ধারণ করবেন, পাশাপাশি আর দশ জনের ৫০ বছরে পদার্পনের জায়গাটি থেকে তার জায়গাটি একেবারেই ভিন্ন।
তাকে তো মাথায় রাখতে হচ্ছে তার পারিবারিক ঐতিহ্য আর সেই সুবাদে সঙ্গত কারণেই গোটা জাতির তার প্রতি বিশাল প্রত্যাশার জায়গাটিকেও। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দিনটির তাৎপর্য সম্ভবত আরো অনেক বেশি। ২৭ তারিখে স্যোশাল মিডিয়ায় একটি ব্যানার ঘুরছিলো- ‘মুজিব থেকে সজীব’। ‘সজীব’ যখন ৫০-এ, তার পিতামহ ‘মুজিব’-এর তখন জন্মশতবার্ষিকী। সংখ্যাতাত্ত্বিক মিলের জায়গা থেকে এটি যে গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই সামান্যতমও। কিন্তু তার চেয়েও বড় জায়গাটি হচ্ছে ছোট্ট এই ব্যানারটির ওজনটি। ‘সজীব’-এর কাছে জাতির প্রত্যাশার ওজনটা এখন ‘মুজিব’সম। আর বিশাল সেই প্রত্যাশার জায়গাটিও একেকজনের কাছে একেক রকমের। কোভিডের ঠিক আগে আগে আমার রাজশাহী যাওয়া পড়েছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লেকচার দেওয়ার সুবাদে। রাজশাহী শহরের বিখ্যাত আমচত্বর পেছনে ফেলে শাহ মখদুম বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার পথে হাতের বায়ে একটা সুউচ্চ নির্মাণাধীন ভবন চোখে পরে।
ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলে বললো, নতুন এই ভবনটিতেই স্থাপিত হবে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ আইটি পার্কটি। ভাবতে বেশ লাগছিলো যে, এই জনপদের অর্থনীতির মূল চালিকাটি আগামীতে আম থেকে আইটিতে প্রতিস্থাপিত হতে যাচ্ছে। চাকরির সুবাদে বনানীর বাসা থেকে কর্মক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়ত নিত্যই। পথে কারওয়ান বাজার। বায়ে তাকালে রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে ঝকঝকে জনতা টাওয়ার। এক সময়কার অপরাধীদের অভয়ারণ্য, পরিত্যক্ত এই ভবনটিতে এখন সারাদিন চলে কতো না জানি অ্যাপ আর সফটওয়্যার তৈরির কাজ।
সেদিন আর এদিনের জনতা টাওয়ার যেন পাকিস্তানপন্থী সামরিক শাসকদের প্রভাব মুক্ত, শেখ হাসিনার আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম ’৭১-এর অবরুদ্ধ বাংলাদেশে। তিনি একাধারে পরাধীন বাংলাদেশের শেষ প্রজন্ম আর প্রথম প্রজন্ম মুক্ত বাংলাদেশের। সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে আমার দ্বিতীয় প্রত্যাশা আমাদের পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক মুক্তি।
তার ৫০-তম জন্মদিনের প্রথম প্রহরে একুশে টিভির জনপ্রিয় টক’শো ‘একুশের রাত’-এ সংযুক্ত ছিলাম মাননীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত চৌধুরীর সঙ্গে। আলোচনা প্রসঙ্গে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, আগামী ক’বছরের মধ্যে তাদের প্রত্যাশা আইটি সেক্টার থেকে আমাদের দেশজ আয় রেডিমেড গার্মেন্টসকে ছাপিয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে ফরেন রেমিটেন্স আর আরএমজি গোলকধাধায় ঘুরতে থাকা আমাদের বৈদেশিক আয়ের উৎসটাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে এই আইটি সেক্টারই। আর সেটি যেদিন সম্ভব হবে সেদিন হয়তো উদ্ভব হবে পৃথিবীর মানচিত্রে সত্যিকারের স্বাবলম্বী বাংলাদেশের।
বন্দীত্ব থেকে মুক্তির পথে বাংলাদেশের যাত্রায় প্রজন্মান্তরের সাক্ষী সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে সঙ্গত কারণেই আমার দ্বিতীয় প্রত্যাশাটি আমাদের পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক মুক্তির। কারণ তার হাত ধরেই শূন্য থেকে মহাশূন্য পানে আমাদের আইটির আজকের মহাযাত্রা। তবে তার কাছে আমার প্রথম প্রত্যাশাটি একেবারেই ভিন্ন। আমি প্রত্যাশা করি তিনি এই জাতির ভবিষ্যতকে নিরাপদ করবেন। কোভিড-১৯-এর ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে আমাদের ‘নিউ নরমাল’ জীবন যাত্রায় যুক্ত হচ্ছে নতুন-নতুন উপাদান।
কোভিড পূর্ববর্তী বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম সমস্যা ছিলো সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ। সমস্যাটি মূলত বৈশ্বিক, তবে বাংলাদেশে এর সঙ্গে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটও যুক্ত হয়েছিলো। ব্রিটিশরাজের সময় থেকেই ভারত তথা আমাদের আজকের এই ভূখণ্ড সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ, ‘৭১-এ ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষ নিধন আর’ ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের দুই দশকের কিছু কম সময় বাদ দিয়ে বাকিটা সময় অবারিত পাকিস্তানপন্থী শাসন- এসব ফেনোমেনন একান্তই আমাদের এই ভূখণ্ডের নিজস্ব। সঙ্গে আরও আছে আমাদের অনন্য ভৌগলিক অবস্থান আর আশপাশের ভ‚-রাজনৈতিক টানাপোড়ন। নিউ নরমাল বাংলাদেশে ঐতিহাসিক বাস্তবতাগুলো ঐতিহাসিক কারণেই থেকে যাবে। তবে সম্ভবত বদলাতে যাচ্ছে নব্য সাম্প্রদায়িক শক্তির বেশ-বাস।
আজকের যে চলমান প্যান্ডেমিক তা কোন বিবেচনাতেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম কিছু নয়। কাজেই বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্ডারে যে পরিবর্তনের স্বাক্ষী আমরা তার পুনরাবৃত্তি যে অত্যাসন্ন, ইতিহাসই তার স্বাক্ষ্য দেয়। এই ‘নব্য স্বাভাবিকতায়’ বদলাতে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির ভাষা, সংস্কৃতি আর এমনকি ধর্মও। একসময় যা ছিলো মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক, কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে অনেক সময়ই তাকে আমরা আসতে দেখেছি পাশ্চাত্য হয়ে। সামনে হয়তো তা আসবে দূরপ্রাচ্যের দরজা দিয়ে। আত্মঘাতি বোমার আঘাতে হয়তোবা বিদীর্ণ হবে না শান্ত পৃথিবী বারবার।
আঘাত হয়তো আসবে ওষুধের মোড়কে কিংবা অন্য কোনোভাবে। তবে যে দরজা দিয়ে, যে বেশে, এদেশে তার আগমন ঘটবে তার প্রধানতম মাধ্যমটি যে হবে ভার্চুয়াল দুনিয়াটা, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্যই। আর সেই জায়গাটায় আমাদের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র করায় যতো না প্রয়োজন সাবমেরিন আর ট্যাঙ্কের, তারচেয়ে শতগুন বেশি প্রয়োজন একজন পোড় খাওয়া, পরিক্ষীত, টেক-সেভি, সৎ নেতার যার প্রতিটি গুন আমি দেখি সজীব ওয়াজেদ জয়ের মধ্যে। তিনি সোনার চামুচ মুখে নিয়ে হার্ভার্ড শিক্ষিত কোনো বঙ্গলাটের সন্তান নন যিনি দেশে ফিরে তার পৈত্রিক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছেন। ক্রমাগত দিয়ে যাওয়া আর বিনিময়ে শুধু সয়ে যাওয়ার পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে, নানা-মামাদের রক্তাক্ত বাংলাদেশকে দেখে-বুঝে-শিখে, নিজ পরিশ্রমে উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ কাম নেতা তিনি। অতএব তার কাছে এ দুটি প্রত্যাশা আমি রাখতেই পারি, তা সে প্রত্যাশার ভার যতোই হোক না কেন।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। এবং সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ