পথের গল্প
রেনু লুৎফা
আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগে লল্ডনে তারাবী নামাজ পড়ার জন্য পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ ছিল না। প্রায় সকলেই পরিবার পরিজন বিহীন অবস্থায় বাস করতেন। বাড়ির চিঠিতে খবর আসতো, কবে ঈদ ছিল, কবে ঈদ বা রোজা আসছে। মাস কয়েক পরে যখন চিঠি হাতে আসতো তখন ঈদ বা রোজা চলে যেতো। বেশীর ভাগ মানুষের বাড়িতেই টেলিফোন ছিল না, মোবাইল ফোন তো তখনো স্বপ্ন। কাছাকাছি একমাত্র মসজিদ ছিল রিজেন্ট পার্ক মসজিদ। কেবল ঈদের নামাজ পড়তে ওখানে যাওয়া হতো।
মৌলানাদেরও তেমন আনাগোনা ছিল না। লন্ডনের বাংগালীরা ( যারা চাইতেন) নিজেদের বাড়িতেই নামাজ পড়তেন। হারাম হালালের তেমন বাছ বিচারও ছিল না, কেউ কেউ মদ পান করলেও শুকুর খেতেন না।
ধীরে ধীরে পরিবার পরিজন আসার সাথে সাথে নামাজ রোজার প্রচলন শুরু হয়। নানা ফন্দি ফিকিরে মোল্লা মুন্সিরাও আসতে শুরু করেন, কারো কারো রেষ্টুরেন্টের উপরে তারাবী নামাজ পড়া শুরু হলো।
পশ্চিম লন্ডনের ওয়েষ্টবোর্ন গ্রোব এলাকায় তখন প্রচুর বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানী রেষ্টুরেন্ট। এলাকায় প্রচুর বাংলাদেশী কর্মচারী। এই এলাকায় রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাওয়া ফ্রি হলেও থাকার জন্য কোন জায়গা ছিল না এখনো নাই । কর্মচারীরা পাশের এলাকাগুলোতে বাস করতেন। বিকাল ৩টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত রেস্টেরেন্ট বন্ধ থাকে। এই সময়ে অনেকেই তাদের বাসস্থলে ফিরে যেতে পারতেন না, বিধায় এই এলাকায় তারা ঘুরে ফিরে সময় কাটাতেন। এই ঘুরে ফিরে সময় কাটানোর জন্য এলাকার জুয়ার দোকান গুলোই ছিল তাদের প্রধান আকর্ষন। এগুলোকে বলা হতো ঘোড়ার ঘর/ কুত্তার ঘর। রেষ্টুরেন্ট কর্মচারীদের মাঝে বিশেষ করে ওয়েটারদের (বেশীর ভাগ) মাঝে জুয়ার দোকানে ঢু মারার বাতিক ছিল খুব। লাভবান হতেন খুব কম। তবে ফতুর হওয়ার সংখ্যাই ছিল প্রচুর। পুরো সপ্তাহ কাজের আয় ঢেলে আসতেন জুয়ার দোকানে। শেফদের বেতন ছিল বেশী তাই যাদের বাতিক ছিল তারা ছুটির দিনটি কাটাতেন গোল্ডেন ন্যাগেট জাতীয় ক্লাবে। জয়ী হলে তো ভাল আর হেরে আসলে মালিকের মাথায় বাজ পড়তো। শেফ কাজে আসবেন না।
আমাদের সাথে তখন একজন শেফ অবস্থান করছিলেন। তিনি ৪০ দশকে জাহাজে করে এসেছিলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন, আমিও তাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। ভাইসাব বলে তাকে ডাকতাম। তখন তার বয়স ৭০ এর কাছাকাছি ছিল। ওসব কোন বাতিক তার ছিল না। আমি খুটিয়ে খুটিয়ে তার বৃটেনের প্রথম জীবনের কথা জানতে চাইতাম। জাহাজে চড়ে প্রথমে নেমেছিলেন সাউথাম্পটন। সে কত কথা। রূপকথাকেও হার মানানো কাহিনী। তার বিগত জীবনের কাহিনী শুনে আমি অবাক হতাম। যত শুনতাম ততোই তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়তো। কর্পদকহীন, ইংরাজী ভাষা না জানা লোকটি একসময় লন্ডনের প্রভাবশালী এলাকায় রেস্টুরেন্ট খুলে ব্যবসা করেছেন। চুটিয়ে ইংরাজী বলেন। সে আরেক অধ্যায়।
ভাইসাব একদিন বেশ বিরক্ত হয়ে জানালেন এইবছর তারাবী পড়ার জন্য স্থানীয় একজন গ্রোসারি দোকানের মালিক তার দোকানের উপর তালায় একটি রুম দিতে রাজী হয়েছেন। ভাড়া দিতে হবে না। নামাজ পড়াবেন এক মুন্সি যিনি এলাকার একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন। ছ’ফিটের কাছাকাছি লম্বা কালো লিকলিকে লোকটির থিতুতে একগুচ্ছ দাড়ি। দাড়ি থাকলেই লোকজন কেন যেন মুন্সি বলে ডাকতে শুরু করেন। লন্ডনে আমি বেশ কয়েকজন মুন্সিকে দেখেছি যারা কোন লেখাপড়া জানতেন না। কি কারনে মুন্সি ডাকতেন তার হাদিস পাইনি। তবে নিশ্চিত তারা কেউই শিক্ষিত ছিলেন না, তবে মানুষ ঠকানোর মুন্সীয়ানা ছিল তাদের। মুন্সী নামাজ পড়াবেন আর যারা নামাজ পড়বেন তারা ইচ্ছেমতো কিছু পাউন্ড দান করবেন তাকে ।
শুরু হলো রোজা মাস। ইফতার করে সকলেই তারাবী পড়ার জন্য দৌড়ান, কিন্ত ভাইসাব যান না, বললেন আমি রুমেই পড়বো। এইভাবে প্রায় ৪/৫ দিন সকলে তারাবি পড়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাড়ি ফিরেন। দীর্ঘ সময় তারাবী না পড়ার জন্য আফসোস শুরু করলেন।
একদিন যথারীতি সকলে তারাবী নামাজ পড়তে গেলেন কিন্তু ফিরে এলেন ১৫ মিনিটের মধ্যেই। দেখে মনে হলো এরা যুদ্ধ করে ফিরছেন। কাপড় চোপড় ছেড়া, রক্তের দাগ। ভয় পেলাম, বর্ণবাদী আক্রমণ নয় তো?
অবশেষে জানা গেল মুন্সি আসলে নামাজের কিছুই জানেন না। বাড়তি আয় করবেন বলে তারাবী নামাজ পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উপস্থিত মুসল্লিদের প্রায় সকলেরই তেমন কোন জ্ঞান ছিল না। কেউই আরবী ভাষা জানতেন না। তবে খটকা ছিল একজন যুবকের মনে। তিনি শুনেন মুন্সি যা আওড়ান তা আসলে কোন ভাষাই নয়। আরবীর আদলে যা পড়েন তা আসলে কোরানের কোন সুরাও নয়। যুবকটি মুন্সি কে চ্যালেঞ্জ করলে মুন্সি তার গলা চেপে ধরেন। শুরু হয় মারামারি। লম্বা মুন্সি নামাজ পড়তে আসা মুস্ললিদের ছুড়ে মারতে শুরু করেন, চারিদিকে শুরু হলো চিৎকার। পাশের দালান থেকে পুলিশ ডাকা হলো পুলিশ আসার আগেই তড়িঘড়ি করে সকলে পালিয়ে এসেছেন। সে প্রায় তিন যুগ আগের কথা।
(রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ)