বঙ্গবন্ধু মাথা নিচু করে জেলখানায় ঢোকেননি বেরও হননি
পঙ্কজ ভট্টাচার্য
১৭ অক্টোরব ১৯৬৭ সাল। স্বাধীন বাংলার ষড়যন্ত্র নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে চার দিন গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে ঢুকেই দেখি কারা হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন মুজিব ভাই (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত তথ্য জানালাম তাঁকে। যার সিংহভাগই ছিল মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, চট্টগ্রামের ডা. জাফর, হান্নান সাহেব, এ কে খান প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি কয়েকজন সেনা অফিসারের বৈঠকের প্রসঙ্গও ছিল ওই জিজ্ঞাসাবাদে।
যাই হোক, ১৯৬৭ সালের ২০ অক্টোবর আমি মুজিব ভাইকে স্মরণ করে দিই সেনা অফিসার ও আমলারা যুক্ত হয়ে আপনার বিরুদ্ধে একটি মামলা প্রস্তুত করছেন। যা পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি পায়। জেলখানায় বেশ কিছুদিন মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। জেলখানায় কথা প্রসঙ্গে মুজিব ভাইকে একটি বইয়ের কথা বলেছিলাম, রাশিয়ার পন্ডিত অধ্যাপক গনকা ভস্তির লেখা ‘এন্ড টেকনিক্যাল স্টাডি অব পাকিস্তান’। যে বইয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি জাতির দীর্ঘ শোষণ ও শাসন করে রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটবে- এমন বিষয় উল্লেখ করা ছিল। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন রাশিয়া থেকে বইটি নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর ছেলে জামালউদ্দিন বাসুর কাছ থেকে বইটি নিয়ে আমি পড়ার সুযোগ পাই। সে বইয়ের তথ্যই আমি মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করি। মুজিব ভাই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এই মর্মে যে প্রচ- আন্দোলন সৃষ্টি হলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে ছয় দফা মেনে নিতে বাধ্য হবে। যা হোক, পরদিন ভোরে মুজিব ভাইয়ের ‘ফালতু’র (সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি যারা জেলখানায় বন্দীদের সেবা করতেন তাদের ফালতু বলা হতো) হাঁকডাকে আমার ঘুম ভাঙে। ফালতু বললেন, ‘নেতা ডেকেছেন, দ্রুত যেতে বলেছেন’। আমি চলে গেলাম, দেখলাম মুজিব ভাই দেওয়ানির উঠানে হুইল চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। তিনি বললেন, গত রাত আমার ঘুম হয়নি। যেসব কথা বলেছিলি উত্তরণের সহজ পথ কী? আমি তাঁকে উত্তর দিলাম, হয়তো সশস্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজন হতে পারে। মুজিব ভাই বললেন, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল, ন্যাপও গণতান্ত্রিক দল। কেউই সশস্ত্র বিপ্লবী পার্টি না। উকিল, মাস্টার, ব্যবসায়ী, কৃষক, কলকারখানার মালিক কেন অস্ত্র ধরতে যাবে? আর স্বাধীনতার জন্য যদি অস্ত্র হাতে নিতেই হয় তাহলে কয়জন নেবে? আমি তালিকা করে দেখেছি ২৭ জন অস্ত্র হাতে নেবে। এর মধ্যে সে সময়কার ছাত্রনেতাসহ বিভিন্ন জেলা নেতার নাম তিনি বললেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের আবদুর রহমান বয়াতির কথাও বলেন। যিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি জনসেবায় বক্তব্য শুরু হওয়ার আগে লোকগান করে জনগণকে মাতিয়ে রাখতেন।
আগেই জানতে পেরেছিলাম মুজিব ভাইকে শাসক গোষ্ঠী মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যাবে। মুজিব ভাইও বিষয়টি জানতেন। কিন্তু দেশবাসীর তীব্র আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এ মামলা টিকবে না, আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম। একদিন মুজিব ভাই বললেন, আমি গত কয়েক বছর বিভিন্ন জেলায় জনসভা করেছি। আমাকে বারবার মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার আরেক জেলায় জনসভা করেছি। জনসভা ও কারাগারে আমার দিন কাটছে। ছেলেমেয়ে কার কত বয়স তা-ও মনে থাকে না। ঈদের দিন তারা ঠিকমতো জামা-জুতা পাচ্ছে কি না তা-ও জানি না। তোদের রেণু ভাবি (বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব) সবকিছু ম্যানেজ করে, আমাকে কিছু জানতেও দেয় না। তবে আমার একটা দুশ্চিন্তা আছে, আমার বড় মেয়ে হাসু (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকনাম) মাকে নিয়ে।
সে সময় আমি ১৯ দিন জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সানিধ্যে ছিলাম। ১৯ দিন পর আমার জামিন হলো, এ খবর শুনে মুজিব ভাই মহাখুশি। বললেন, রেডি হ। আমি নিজে তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব। জেলখানার গেটে এসে মুজিব ভাই হাঁক ছেড়ে বললেন, জেলার সাহেব কোথায়? আমার ভাই কুঠিরি দিয়ে মাথা নিচু করে জেলখানা থেকে বের হবে না। শেখ মুজিব কখনো মাথা নিচু করে জেলখানায় ঢোকে না। মাথা নিচু করে জেলখানা থেকে বের হয় না। মুখে পাইপ নিয়ে ঢোকে। আবার পাইপ নিয়েই মেইন গেট দিয়ে বের হয়। দেখলাম খুব কম সময়ের মধ্যে ডেপুটি জেলার নির্মল সিনহা সাহেব এলেন। জমাদারকে মেইন গেট খুলে দিতে বললেন। মুজিব ভাই আমাকে বকুল ফুলের মালা দিয়ে বিদায় দিলেন আর বললেন, ছাত্রদের ঐক্য ধরে রাখিস। থামতে দিবি না। মামাকে (শহীদুল্লা কায়সার) বলিস, আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যটা যেন ধরে রাখে। যত বাধাই আসুক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আর মামাকে দিয়ে রাশিয়ার পন্ডিত সাহেবের বইটি জেলখানায় পাঠিয়ে দিস। এর মধ্যে গণঅভুত্থ্যান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন। দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বজয়ীর বেশে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলেন। আমি ১২ জানুুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘কী রে রাশিয়ার বইটি তো দিলি না? বইটি না পড়লেও বইয়ের কথা অনুযায়ী কাজ তো করেছি, কী বলিস?’ অবাক হলাম মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি দেখে। লজ্জিত ও গর্বিত হলাম। ঘটনাটি যদিও ভুলেই গেয়েছিলাম। মুজিব ভাই কখনো মাথা নিচু করে জেলখানায় ঢোকেননি, বেরও হননি।
পংকজ ভট্টাচার্য: রাজনীতিক, ষাটের দশকের ছাত্রনেতা, ঐক্যন্যাপ সভাপতি
অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি।