মমতার বিকল্প ?
ড. দিলীপ মজুমদার
ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হল।বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে ৫৮ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করে, ৮টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে এগিয়ে থেকে তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় , নিজের আগের রেকর্ড ভেঙে জয়ী হলেন।মমতার জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না ।তবু বিজেপির প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে টিভি চ্যানেলগুলির একটা প্রচার ছিল।প্রিয়াঙ্কা জিতবেন,এ কথা বলা না হলেও প্রকারান্তরে ‘টক্কর’ বা ‘লড়াই’এর কথা বলছিলেন তাঁরা নানাভাবে । বিজেপি নেতৃত্বই এই প্রচারটাকে যে উস্কে দিয়েছিলেন, সেটা অনুমান করা যায় ।না জিতুন বিজেপি প্রার্থী, কিন্তু তিনি যেন টক্কর দিতে পারেন ; মমতার একটা বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন।এটাই ছিল বিজেপির অভিপ্রেত ।
সন্দেহ নেই বিজেপি পুরুষতান্ত্রিক ও পুরুষশাসিত দল।তাঁরা মেনে নিতে পারেন নি ‘একা এক নারীর’র এইরকম শক্তি ও প্রভাবকে।২০২১ সালের নির্বাচনের ধাক্কাটাও মেনে নিতে পারেন নি তাঁরা । যেমন ২০১১ সালের ধাক্কা মেনে নিতে পারেন নি সিপিএম । নারীদের প্রতি সম্মানজনক ভরসা না থাকলেও বিজেপি মমতার বিকল্প নেত্রীর সন্ধানে ছিলেন । রূপা গাঙ্গুলী, লকেট চ্যাটার্জীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁরা । কিন্তু সার্থকতার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেন নি রূপা অথবা লকেট । এখন তো রূপা গাঙ্গুলি অনেকটা দূরে সরে গেছেন, লকেট তো ভবানীপুরে প্রচারেই এলেন না । কুনাল ঘোষের কথা সত্য হলে বুঝতে হবে লকেটের মধ্যে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছে ।বিজেপি নেতৃত্ব টক্কর দেবার জন্য যে প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে এগিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর চলনে-বলনে মমতার মতো ‘অগ্নিকন্য’ হবার অভিনয় করেছিলেন, বলেছিলেন অনেক গরমগরম কথা, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, এমন কি পরাজিত হবার পরেও এনেছেন ছাপ্পা ভোটের প্রসঙ্গ । এটা শেষ পর্যন্ত হাসির খোরাক হবে । কারণ তাঁদের নির্বাচন কমিশনই সেসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ।
বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ । শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, প্রিয়াঙ্কা যদি জেতেন, তাহলে বিরোধী দলনেতার পদ তিনি ছেড়ে দেবেন । এ কথা বলতে পেরেছিলেন শুভেন্দু, কারণ তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে ভবানীপুরে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী । তৃণমূলকে একটু ঘাবড়ে দেওয়া, তাঁদের কর্মিদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্ট করার জন্য প্রিয়াঙ্কাকে আসরে নামানো । একজন রাজনৈতিক নেতা যাঁকে ‘শাউটিং ভাবিজি’ আখ্যা দিয়েছেন ।(পরের পাতা )শুধু বিজেপি নয়, এর আগে কংগ্রেস ও সিপিএমও মমতার বিকল্প সন্ধান করেছিলেন । দীপা দাশমুন্সীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস । তারপরে দীপা দূরে সরে গেলেন রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে । চেষ্টা সিপিএমও করেছেন ।
সাম্প্রতিককালে মীনাক্ষীর মতো তরুণীদের সামনে আনার চেষ্টা করেছেন । উল্টোদিকে অজন্তা বিশ্বাস ও বসুন্ধরা গোস্বামীর মতো বামপন্থীরা মমতার ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন সম্ভাব্য শাস্তির কথা মাথায় রেখেও । বিজেপিকে পুরুষতান্ত্রিক দল বলেছি, কিন্তু বামেরাও প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষতান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত । তা না হলে সে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নারীশক্তির প্রাধান্য নেই কেন ? একবার বৃন্দা কারাতের মুখে সেই অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছিল ।একজন মানুষের বিকল্প অন্য মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় । মনস্তা্ত্বিক বিচারে মমতা ব্যনার্জীর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমি ২০১১ সালে নির্বাচনের আগে ‘একা এক নারী : প্রতিপক্ষ কয়েকজন’ বইতে বিশ্লেষণ করেছিলাম, তার সারবত্তা ঘটনাধারায় প্রমাণিত । তাঁর সহজিয়া ভঙ্গী একেবারে ব্যতিক্রমী । চেহেরায়, চলনে-বলনে একেবারে ঘরোয়া নারী । চাপা হাসি মাপা কথার মানুষ নন । রাগ হলে সেই রাগ প্রকাশ করেন রাখ-ঢাক না করে । সভায় বক্তৃতা করতে করতে কর্মী- সমর্থকদের ধমকে ওঠেন, নতুন কোন অতিথি সভায় এলে বক্তৃতা থামিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে আসেন । বিবাহাদি করেন নি, কিন্তু ব্যাচিলারসুলভ রুক্ষতা দেখা যায় না । পরিবারের প্রতি, কর্মী-সমর্থকের প্রতি তাঁর মমতা দৃষ্টিগোচর হয় ।
সেই সহজিয়া ভাবটি দেখা যায় তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদে । সরু পাড়, হালকা রঙের শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চপ্পল । হাতে রুমাল নেই, শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে নেন । কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ । পোশাক পরিচ্ছদে তিনি কী সচেতনভাবে গাঁধিজিকে অনুসরণ করেন ? হতে পারে । দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে গাঁধিজি আর কোট-প্যান্ট পরেন নি, কারণ তা পরলে ভারতের সাধারণ মানুষের মনের ভেতর প্রবেশ করতে পারতেন না । তাঁর হাওয়াই চটি নিয়ে বিরোধীরা ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি, কারণ তাঁরা এই প্রতীকের রহস্যভেদ করতে পারেন নি । দেবাংশু সেই প্রতীকটি ধরে লিখেছিলেন চমৎকার স্লোগান : ‘দিল্লি যাবে হাওয়াই চটি’ । পোশাকের মতো আহারেও দেশজ প্রীতি । ঘরেভাজা মুড়ির প্রতি আসক্তি ।
অসাধারণ তাঁর স্মৃতিশক্তি।রাস্তার নাম, ব্লক বা থানার নাম, ব্যক্তির নাম, নানা পরিসংখ্যান বলে যান অবলীলাক্রমে।যাকে বলে হাতের তালুর মতো চেনা । শুধু মন্ত্রী, বিধায়ক, পৌরপিতা নন, বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ কর্মীকেও ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তিনি, চেনেন বিভিন্ন আধিকারিক ও পুলিশকর্মীকে।এরপরে আসে তাঁর বক্তৃতার কথা।সেখানেও তিনি নতুন এক ঘরানা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।সে তো শুধু বক্তৃতা নয়, সে যে আলাপ,শ্রোতার সঙ্গে কথোপকথন, ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরা, শাড়ির আঁচল মুখে বুলিয়ে নেওয়া ।এভাবে তাঁর বক্তৃতার বিষয় শরীরী হয়, জনতার মন স্পর্শ করে যায় ।সাহস কিংবা দুঃসাহসেও মমতা অনন্যসাধারণ । হঠাৎ বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।মন্ত্রিত্ব ত্যাগ, কংগ্রেসের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ, সিপিএমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই এ সব তার উদাহরণ।একদিন তিনি সিপিএমের মতো ক্যাডারভিত্তিক, শৃঙ্খলাপরায়ণ,৩৪ বছরের ক্ষমতার অধিকারী সিপিএমের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।সহ্য করতে হয়েছে অপরিসীম বিদ্রূপ,আক্রমণ, চরিত্রহননের কালিমালিপ্ত অভিযান। আর সাম্প্রতিককালে সেদিনের মতো প্রায় এককভাবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, ক্যাডারভিত্তিক বিজেপির বিরুদ্ধে শুরু করেছেন জেহাদ ।এককভাবে’,কারণ ভারতবর্ষের অন্য কোন দলকে দাঁতে দাঁত চেপে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখিনি আমরা ।
সিপিএমের ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব যে বালসুলভ চাপল্য সে কথা প্রমাণিত হয়েছে গত নির্বাচনে মোদী-শাহের রণংদেহি প্রচারে, প্রমাণিত হয়েছে এবারের উপনির্বাচনেও।সর্বভারতীয় দল’ কংগ্রেসের গোঁসা হতে পারে,কিন্তু এই মুহুর্তে ‘বিজেপি বিরোধী মুখ’ যে মমতা,সে কথা নিরপেক্ষ বিশ্লেষককে স্বীকার করতে হবে।দুঃসাহসের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে মমতাকে,আবার এর জন্য তিনি লাভ করেছেন বরমাল্য।রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা দুঃসাহসের সৃষ্টি ।মমতার মতো চলিষ্ণুতা অন্য কোন নেতার মধ্যে আমরা দেখতে পাই না।পথপরিক্রমায় ক্লান্তিহীন তিনি।সকালে বারাসত, দুপুরে জঙ্গীপুর, রাতে দিল্লি।এই দলীব কর্মিদের সঙ্গে আলোচনা, এই বোলপুরের জনসভা, এই রাজ্যপালের কাছে অভিযান।অবিরাম পথপরিক্রমায় নারীর কিছু ব্যক্তিগত বাধা থাকে, কিন্তু মমতা সে সব বাধা গ্রাহ্য করেন নি।এই চলমানতার মধ্যে প্রকাশ পায় তাঁর দুর্বার প্রাণশক্তি।এই প্রাণশক্তি উদ্বেগ নিরোধক।তাই মমতাকে ভুগতে হয় না চিন্তাজ্বরে।চিন্তাজ্বর থাকে না বলে তাঁর শরীর সর্বদা ‘ফিট’।এই যাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর বিকল্প কোথায় ? মমতা একক।মমতা স্বভাবত স্বতন্ত্র।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।