ইসহাক কাজল: বিদ্রোহী রণক্লান্ত, অবশেষে তিনি শান্ত
সৈয়দ আনাস পাশা
সাংবাদিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধা ইসহাক কাজলের মৃত্যুর পরপরই আমার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিলো এই শিরোনামটি-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, অবশেষে তিনি শান্ত।
১৪ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার কাজল ভাইয়ের বিলেত জীবনের কর্মস্থল সাপ্তাহিক জনমত-এর উদ্যোগে আয়োজিত শোকসভায় বিশেষ অসুবিধা হেতু যেতে না পারায় যখন মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম, তখন বারবারই মনে পড়ছিলো ক্লান্তিহীন এই বিদ্রোহীর কথা। আন্দোলন সংগ্রামের মাটে পাশাপাশি হাটতে গিয়ে কত যে স্মৃতি জমা হয়েছে তাঁকে নিয়ে, তিনি বেঁচে থাকতে এগুলো বুঝতে পারিনি।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিশুদ্ধ একজন মানুষ ছিলেন আমাদের কাজল ভাই (ইসহাক কাজল)।
জীবিতাবস্থায় সাপ্তাহিক জনমত-এর উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত ‘একজন ইসহাক কাজল’ গ্রন্থে আমার লেখার শিরোনাম ছিলো ‘কলম ও রাজপথ দুটোই যার দখলে’। এখন হিসেব মিলিয়ে দেখি তাঁর দখলে ঐ শিরোনামটির চেয়েও বেশি আরও অনেক কিছু ছিলো।
তাঁর মৃত্যুর পর সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষ-কোথায় উঠেনি বেদনার রুল, কোথায় ছিলোনা শোকের আবহ? তাঁর মৃত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এটিই প্রমান হয়েছে যে একজন ইসহাক কাজল ছিলেন সার্বজনীন।
একটি নির্দিষ্ট আদর্শ নির্লোভ ভাবে মনেপ্রাণে লালন করলে যে খুব সহজেই সাহসি হওয়া যায় কাজল ভাই তার উদাহরণ। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, অকপটে সাহসের সাথে তা সবার সামনে প্রকাশ করার এক অসাধারণ গুন ছিলো তাঁর।
বৃহত্তর সিলেটের রাজপথ কাঁপানো রাজনৈতিক কর্মী কাজল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। ৮০র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে তাঁর সাথে পরিচয় হলেও ঘনিষ্টতা এই ব্রিটেনে, সেই ২০০০ সাল থেকে। এই ঘনিষ্ঠতা কখন যে এসে ঠেকেছিলো বন্ধুত্বের পর্যায়ে তা টেরই পাইনি। এই বন্ধুত্ব একই আন্দোলনের অসম বয়সী দুই সহযোদ্ধার।
কাজল ভাই ছিলেন একজন সংগ্রামী মানুষ। নিজের বিশ্বাস আকড়ে ধরে সংগ্রাম করে করে কিভাবে ঠিকে থাকতে হয় তা তিনি জানতেন। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে আমাদের এই সাহসি সহযোদ্ধা যখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন হয়তো আর বড়জোড় দু-চার-ছয়মাস বেঁচে আছেন। কিন্তু ইসহাক ভাই বেঁচে থাকার এই সংগ্রামেও হাল ছাড়েননি। মরনব্যাধি বুকে নিয়েই দীর্ঘদিন সক্রিয় থেকেছেন তাঁর আদর্শিক ও কর্ম আঙিনায়। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পরও দীর্ঘ ৫ বছর বেঁচে থেকে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন কিভাবে ঠিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়।
সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ইসহাক কাজল হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী। তাঁর বিদ্রোহ ছিলো প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শোষিতের রক্তচোষা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। একটি শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর এই সংগ্রামে ক্লান্তি যখন তাঁকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা করেছে তখনই আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন তিনি, যেভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পরও বারবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। গত নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক, মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ স্মরণে লন্ডনে একটি নাগরিক শোকসভার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। প্রস্তুতি সভা শেষে তাঁকে ফোন করে উদ্যোগটির কথা জানালে বললেন, ‘পত্রিকায় দেখেছি। আমিতো মনে করেছি আপনারা আমাকে ভুলে গেছেন। এখনও মনে রেখেছেন যেনে ভালো লাগলো। স্মরণ সভার দিনটি পর্যন্ত চলা ফেরার সামান্যতম ক্ষমতা থাকলেও আমি আসবো।’
স্মরণ সভায় নির্ধারিত দিনে অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজল ভাই আসলেন। আমরা তাকে স্টেইজে অতিথিদের সাথে নিয়ে বসালাম। সভা শেষে স্টেইজ থেকে নেমে আমাকে বললেন, ‘আমাকে সম্মানিত অতিথিদের সাথে স্টেইজে বসার সুযোগ দিয়ে যেভাবে সম্মানিত করলেন, জীবনের শেষ সময়ে এসে এতে আমি অভিভূত’। হেসে হেসে বললেন, ‘বুঝলাম মৃত্যুর পরও সহজে আপনারা ভুলবেন না আমাকে’।
যৌবন থেকে পৌঢ়ত্ব পুরো সময়ই কাজল ভাই যুদ্ধ করেছেন রাজপথে। একটি আলোকিত সমাজের পক্ষে যার কলম চলেছে অবিরত সেই বিদ্রোহী মানুষটি রণক্লান্ত হয়ে এখন নিরবে ঘুমিয়ে আছেন ‘গার্ডেন অফ পিস’-এ মাটির নিচে।
অসুস্থকালীন সময়ে তাঁকে দেখতে গেলে দোরারোগ্য ব্যধিতে শয্যাশায়ী থেকেও তিনি দেশ, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতেন। ঘুর্নাক্ষরেও নিজের অসুখটাকে আলাপের আবর্তে টেনে আনতেন না।
কাজল ভাইয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্র হাতে তিনি যুদ্ধ করেছেন শত্রু বাহিনীর বিরোদ্ধে। দুটো বিষয়ে তাঁর কাছে ‘আপোষ’ নামে কোন শব্দ ছিলোনা। এর একটি হলো মুক্তিযুদ্ধ আরেকটি বঙ্গবন্ধু। এ বিষয়গুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি।
জয় বাংলা স্লোগান দিতে গিয়ে অনেক বাম বন্ধুই যেখানে ক্ষনিকের জন্য হলেও দ্বিধায় ভুগেন, সেখানে বাম রাজনীতিক ইসহাক কাজলের কন্ঠে তা বেজেছে বজ্রকন্ঠে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ইসহাক কাজল তাঁর সাহসি যৌবন দিয়ে যেমন
কাঁপিয়েছেন রাজনীতির অঙ্গন,
ঠিক তেমনি একটি আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর কলম চলেছে অবিরত। একজন খ্যতিমান সাংবাদিক ও রাজনীতিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়েই তাঁর স্বাচ্ছন্ধ্য ছিলো বেশি। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক, জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক, সিলেট জেলা শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখার অনারারী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এই প্লাটফর্মে একসাথে আন্দোলন করেছি আমরা। সভাপতি হিসেবে প্রয়াত ডা বি বি চৌধুরীর সাথে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর কাজল ভাই’র সাথেও একই পদে দায়িত্ব পালন করেছি আমি। ঐসময় দেখেছি দায়িত্ব ও নিজ বিশ্বাসের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট।
একজন উদার ও আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন আমাদের কাজল ভাই। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম তাঁকে একজন সুপরিচিত নেতা হিসেবে সকলের কাছে প্রিয় করে তুলেছিলো। দেশের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন কাজল ভাই ছিলেন সব সময়ই সোচ্চার। জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস যাতে বিদেশীদের কব্জায় না যায় তাঁর জন্যে সেই প্রথম থেকেই বজ্রকন্ঠ নিয়ে রাজপথে ছিলো তাঁর অবস্থান। এই আন্দোলনে এতই তাঁর সম্পৃক্ততা যে, আমরা বন্ধু-বান্ধবরা রশিকতা করে অনেক সময় তেল-গ্যাস নামেই তাঁকে সম্বোধন করতাম। নিপিড়ীত মানুষের বন্ধু ইসহাক কাজলের স্বপ্ন শোষনহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। বিত্তহীন ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষ মানুষের অধিকার নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকুক এটিই তাঁর ইচ্ছে। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে কাজল ভাই সব সময়ই ছিলেন সোচ্চার। যুক্তরাজ্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাথে ঘনিষ্ট ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবোনাল গঠিত হওয়ার পর কাজল ভাই বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন বুঝি এবার স্বার্থক হবে’। এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিশ্বব্যাপী জামাতী অপপ্রচার মোকাবেলায় লন্ডনে নির্মূল কমিটিকে কর্মসূচী দিয়ে মাটে রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন ইসহাক কাজল।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতিয়তাবাদ ও মনুষ্যত্ব এগুলো কাজল ভাইয়ের জীবনাদর্শ। এ নীতিগুলোর সাথে কখনও আপোষ করেননি তিনি।
আমাদের সমাজ দিনের পর দিন অধ:পতনের দিকে ধাবিত হওয়ার এই সময়ে ইসহাক কাজলের মত লোকের যখন খুব বেশি প্রয়োজন,
ঠিক তখনই তিনি চলে গেলেন। সমাজকে ঘোর তমসাচ্ছন্ন অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার অব্যাহত সংগ্রামে তাঁর মত লোকের কর্মস্পৃহা ও দক্ষতা যে আমাদের খুবই প্রয়োজন ছিলো এই মূহুর্তে।
কাজল ভাই, মুক্তিযুদ্ধের আপনার সেই রনাঙ্গনস্থল এখনও আমার দেখা হয়নি। আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন সেইসব জায়গায় নিয়ে যাবেন। সে কথা না রেখেই চলে গেলেন?
শান্তিতে ঘুমান কাজল ভাই, আপনি এখন রণক্লান্ত। আপনার এই ক্লান্তি থেকেই শুরু হোক বর্তমান প্রজন্মের নতুন রণ উন্মাধনা, যে উন্মাধনা আপনার স্বপ্ন একটি শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে।
লেখক: সাংবাদিক, সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক