করোনাবাসের ছয়মাস আর সেপ্টেম্বরের আগে পরে
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
ইটিভিতে একুশে রাতের স্টুডিওতে বসে প্রথম দিনটির তাৎপর্যটা বুঝতে পারলাম।দিনটি ৮ সেপ্টেম্বর।ছ’মাস আগে এই দিনেই বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হন।সেই থেকে জীবনটার খোলনলচে পাল্টে দেয়া এই ছয়টি মাস।আর সামনে এমন ছয় মাস আর কয়টি যে আসবে তা-ই বা কে জানে?
আমাদের এই ছয়টি মাসের অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র। আমাদের সাফল্য আছে অনেক, ব্যর্থতাও আছে কিছু কিছু। ব্যর্থতা যেমন আছে পিপিই কেনা নিয়ে, মাস্ক কিংবা পিসিআর-এর ভাওতাবাজিতে, তেমনি শুরুর দিকটায় সংকট ছিল হাসপাতালের কোভিড-নন কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিয়েও। আবার এও ঠিক, মার্চ-এপ্রিল মাসে যখন দেশি-বিদেশি জার্নাল আর ম্যাগাজিনে হিসেব কষা হচ্ছিল কোভিডে বাংলাদেশে মারা যাবে কত মানুষ – বিশ লক্ষ না ত্রিশ, কিংবা বলা হচ্ছিল ভেন্টিলেটর আর হাসপাতালে বিছানার অভাবে রাস্তায় পড়ে থাকবে বাঙালির মৃতদেহ, বাস্তবে কিন্তু হয়েছে তার ঠিক উল্টো। রোগীর অভাবে এখন বরং হাহাকার করছে ভেন্টিলেটর আর কোভিড হাসপাতালের বেডগুলো। মৃত্যুর হার বাংলাদেশে ওঠানামা করছে ১.২ থেকে ১.৪ শতাংশের ভেতরে, যা পৃথিবীতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যার তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো প্রত্যাশিত ৮ শতাংশ ছুঁতে পারেনি, কিন্তু ৫ শতাংশ তো ছুয়েছে ঠিকই। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে পৃথিবীর অনেক দেশের প্রবৃদ্ধিই এখন ঋণাত্মকের ঘরে।
মাসের পর মাস লকডাউন, আম্ফান আর সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে তো পড়েইনি বরং তা এখন ঊর্ধ্বগামী। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম দুটি মাসে আমাদের বৈদেশিক রপ্তানি বেড়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই শতাংশ। ধারণা করা হয়েছিল এক কোটি প্রবাসী বাঙালির মধ্যে অধিকাংশই দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন, কিন্তু কার্যত ফিরে এসেছেন এক লাখেরও কম।
অনেক ভালো আর কিছু কিছু খারাপ নিয়ে আমাদের কোভিড-এর এই প্রথম ছয়টি মাস পার হয়েছে। সাফল্যে ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই আমাদের এখনও। বরং শেখার অনেক কিছুই আছে আমাদের ব্যর্থতাগুলো থেকে। শিখতে হবে এবং শিখে-বুঝে আমাদের নিউ নরমাল জীবনের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে আমাদের নিউ নরমাল জীবনটাকে নরমাল জীবনটার যতটা কাছাকাছি নেয়া যায়। কারণ এর বিকল্প আর কোনো কিছু আমাদের সামনে নাই।
আমার ধারণা, অনাগত আগামীতে আমাদের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে ভ্যাকসিন। কোন ভ্যাকসিন? এটা একটা বড় প্রশ্ন তো বটেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ১৯০টির বেশি করোনাভ্যাকসিন ডেভলপমেন্ট প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় ধাপে আছে ৯টি। একটি ভ্যাকসিন চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে রাশিয়ায় স্পুটনিক-৫। এটি তৈরি করেছে রাশিয়ার ‘গ্যামেলেই ইন্সটিটিউট অব এপিডেমিয়োলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে সিরাম ইন্সটিটিউট ইন্ডিয়া, ভারত বায়োটেক, সিনভ্যাক আর গ্যামেলাই-এর ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভবনা আমাদের প্রবল। পাশাপাশি কোভেক্স ফোরামের আওতায় ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মনে রাখতে হবে শুধু অর্থ দিয়ে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না, লাগবে কুটনীতিও, লাগবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ হস্তক্ষেপ। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যাপারটিও। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালই শেষ কথা নয়। ভ্যাকসিন আনার আগে সংশ্লিষ্ট দেশ ও প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন উৎপাদনের অভিজ্ঞতা এবং বুৎপত্তি ইত্যাদিও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ ট্রায়াল হবে সামান্য ক’টি ডোজের আর ভ্যাকসিন ব্যবহার হবে কোটি-কোটি ডোজ। পাশাপাশি উৎপাদক দেশের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলোও মাথায় নিতে হবে। সুসময়ের বন্ধুর বদলে জোর দিতে হবে দুঃসময়ের প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের ওপর। মনে রাখতে হবে কোভিড-উত্তর পৃথিবীটা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মতোই আর ভ্যাকসিন সেখানে হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবে আমাদের কপাল এদিক থেকে বেশ ভালো। আমাদের জঠর যাতনার সাথী ভারত এবং রাশিয়া এই দু’দেশই ভ্যাকসিন দৌড়ে এগিয়ে আছে ভালোভাবেই। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও পাওয়া গেছে এই দুটি দেশ থেকেই জি২জি পর্যায়ে।
দেশে কারা আগে ভ্যাকসিন পাবেন সেটি নির্ধারণ করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ফ্রন্টলাইন ফাইটাররা পাবেন, এ ধরনের মোটা দাগের সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়। যেমন স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মধ্যে যারা কোভিড হাসপাতালে কর্মরত শুধু তারাই ভ্যাকসিন পাবেন, না যারা নন-কোভিডে কাজ করছেন শিকে ছিড়বে তাদের কপালেও, সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের মধ্যে ভ্যাকসিন পাবেন কারা, শুধু যারা মাঠের তারা নাকি অন্যান্যরাও। তেমনি মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারাই কী শুধু ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আসবেন না সুযোগ পাবেন অন্যরাও? ব্যাংকারদের ক্ষেত্রে কী শুধু তারাই ভ্যাকসিন পাবেন যারা ক্যাশ হ্যান্ডেল করছেন, নাকি সব ব্যাংকারই এই সুবিধার আওতায় থাকবেন ইত্যাদি সিদ্ধান্তগুলো এখন থেকেই ঠিকঠাক নিয়ে রাখতে হবে।
মানুষের সচেতনতা সৃষ্টিটাও অত্যন্ত জরুরি। মানুষকে ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশের মাস্ক ব্যবসায়ীদের ইদানীং যে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য যেমন কিছু মানুষ অধীর আগ্রহে মুখিয়ে আছে, তেমনি ভ্যাকসিনে অবিশ্বাসীর সংখ্যাও নেহায়েত এদেশে কম নয়। কাজেই সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হলে এ ব্যাপারে সময়মতো জনমত সৃষ্টির কাজ শুরু করাটাও জরুরি।
কোভিডে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকাটা অনেক লম্বা। কমেছে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, থমকে গিয়েছিল আমাদের উন্নয়নের চাকা, বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো – তালিকায় আছে এমনি অনেক কিছুই। আবার এও মনে রাখতে হবে যে এসব ক্ষতিই বাঙালি কাটিয়ে উঠতে পারবে। তবে এবার এমন কিছু ক্ষতি কোভিড আমাদের করে গেল যা কখনই কাটিয়ে ওঠার নয়। পাব কি আমরা কখনো আর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম আর সাহারা খাতুনের মতো দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ কিংবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আর কামাল লোহানীর মতো জাতীয় সম্পদ? কোথায় পাবো মুক্তিযোদ্ধা তারেক আলীকে কিংবা অধ্যাপক কিবরিয়ার মতো বরেণ্য চিকিৎসককে? ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ফিট লিস্টটা যখন তৈরি করা হবে তখন মাথায় রাখতে হবে এদিকটাও। ভবিষ্যতে জাতি যেন মেধাশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে না পড়ে সেদিকটি বিবেচনায় রাখতেই হবে অগ্রাধিকারের সাথে।
প্রশ্ন আছে আরও। যারা কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন তাদের কি হবে? তারা কি ভ্যাকসিন পাবেন, না পাবেন না? পেলে কতদিন পর? কোভিড যে দ্বিতীয়বার হতে পারে সেকথা এখন সবারই জানা। তবে সার্স-কোভ-২-এর ন্যাচারাল ইমিউনিটির স্থায়িত্ব কতদিন তা আমাদের অজানা। করোনা পরিবারের অন্যান্য ভাইরাসদের সাথে আমাদের যতটুকু জানাশোনা, তা থেকে আমরা জানি এসব ভাইরাসের ক্ষেত্রে যে ন্যাচারাল ইমিউনিটি তৈরি হয় তার স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক মাস মাত্র। আমেরিকান সিডিসি তাদের সাম্প্রতিকতম কোভিড-১৯ আপডেটেও জানিয়েছে কোভিড-১৯ থেকে সেড়ে ওঠার তিন মাসের মধ্যে আবারো সার্স-কোভ-২ পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সেড়ে ওঠার তিন মাস পরে কোভিড-লাইক সিম্পটম দেখা দিলে এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়লে আবারো সার্স-কোভ-২ পরীক্ষা করা যেতে পারে। এসব বিবেচনায় ধারণা করা যেতে পারে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনে যে ইমিউনিটি তৈরি হবে তার স্থায়িত্ব হবে হয়তো কয়েক মাস কিংবা আরও কম-বেশি কিছুদিন, কিন্তু সারাজীবনের জন্য নয়। কাজেই যাদের একবার কোভিড সংক্রমণ হয়েছে, তারা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে পারবেন কি পারবেন না সেটিও বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে বিবেচনায় আনতে হবে বৈকি।
পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে যে ভ্যাকসিনই একমাত্র সমাধান নয়। মানুষ এ পর্যন্ত একটি মাত্র ভাইরাসকে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় জানাতে পেরেছে আর তা হল স্মলপক্স। এমনকি পোলিওকেও আমরা আজ পর্যন্ত পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারিনি। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। এ ভাইরাসের ভ্যাকসিনটি বাজারে আছে ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। বাংলাদেশে সরকারের আন্তরিকতায় গত ১৫ বছর ধরে ইপিআই সিডিউলে দেশের প্রতিটি নবজাতক শিশুকে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। এক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত এবং প্রশংসিত। তবুও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে আজও বাংলাদেশে পাঁচ শতাংশেরও বেশি নাগরিক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত।
কাজেই শুধু ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না, পাশাপাশি জনসচেতনা সৃষ্টির যে কঠিন কাজটি চলমান তাও চালিয়ে যেতে হবে। মাথায় রাখতে হবে এই যে ‘নিউ নরমাল’ জীবন যাত্রা, তা সহসাই ‘নরমালের’ দিকে যাচ্ছে না। ভ্যাকসিন আমাদের নিউ নরমাল জীবনটাকে আরেকটু নরমাল করবে মাত্র। আর সাথে যদি আমরা আরেকটু সচেতন হই, আরেকটু বেশি-বেশি মাস্ক ব্যাবহার করি, হাতটা নিয়মিত ধুই আর শারীরিক দূরত্বটুকু বজায় রাখি, তাহলে আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি যে আমাদের নিউ নরমাল জীবনযাত্রাটাকে নরমাল করতে আমাদের আরেকটু কম অপেক্ষা করতে হবে।
মামুন আল মাহতাববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।