কোভিড-১৯ এর বাস্তবতায় শেখ কামালের শূন্যতা
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিন।শেখ কামাল ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি,এ পৃথিবীতে যার ব্যাপ্তিকাল তিনটি দশকও স্থায়ী হয়নি,অথচ বহুমাত্রিকতায় এই স্বল্পস্থায়ী জীবনেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। আজ তার জন্মদিনে তাকে নিয়ে এই লেখার পরবর্তী অংশে আমার যে ভাব সম্প্রসারণ,তার সারমর্ম এতটুকুই।
শেখ কামাল যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১-এর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অসমের ডুয়ার্সের জঙ্গলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের ট্রেনিংয়ের কঠিন সময়গুলো তিনি পার করেছিলেন স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে। তিস্তার শাখা নদীতে ট্রেনিংয়ের সময় হারিয়ে যাওয়া রাইফেল উদ্ধারে ট্রেইনি সেনা অফিসারদের পাঁচ দিনব্যাপী প্রাণান্ত প্রয়াসে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। এ্যামবুশ ট্রেনিংয়ের সময় দুর্ঘটনাক্রমে আহত ক্যাডেট অফিসারকে ট্রাক্টরে তুলে এমআই রুমে নিয়ে ছুটেছিলেন শেখ কামালই। মশার কামড়ে রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেননি। তারপরও কঠিন ট্রেনিং শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কমনরুমে হারিকেনের আলোয় হারমোনিয়ামে স্বাধীন বাংলা বেতারে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন সহকর্মীদের। কোন কারণ ছাড়াই কমান্ডেন্টের কাছে তাকে প্রকাশ্যে শুনতে হয়েছে রাষ্ট্রপতির ছেলে হিসেবে তিনি যেন ট্রেনিংয়ে কোন বাড়তি সুবিধা প্রত্যাশা না করেন। প্রতিবাদ তো দূরে থাক টু-শব্দটিও করেননি। অথচ ক্যাডেট অফিসারদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের প্রতিবাদে প্রতিবাদী হয়েছিলেন উচ্চকণ্ঠে। আর ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশনপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (অবঃ) শেখ কামালের নাম ছিল মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থানে। স্বাধীন দেশে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে একদিকে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি ছাত্রসমাজকে খেলায়-গানে-নাটকে মাতিয়ে একটা সুন্দর সমাজের প্রত্যাশায় কাজও শুরু করেছিলেন।
আবাহনী ক্রীড়া চক্রের যাত্রা শুরু তার হাতে ধরে, একথা জানা সবার। কিন্তু আমরা কি জানি আধুনিক জার্সি পরে, আধুনিক বুট পায়ে, আধুনিক ফুটবল দিয়ে ছোট-ছোট পাসে এদেশে আধুনিক ফুটবল খেলার জনকও তিনি। খেলতেন নিজেও। খেলতেন ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল আর ভলিবল। খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়াচক্র আর স্পারস-এ। বিশ্বাস করতেন একজন ক্রীড়াবিদের মাধ্যমেও একটি জাতি পরিচিতি পেতে পারে বিশ্বব্যাপী। একজন সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সালমা কিংবা কমলা সুন্দরের কিশোরীরা কি আজ আমাদের তাই করে দেখাচ্ছেন না?
শুধু আবাহনী-ই না, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ইস্ট এ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাব আর কামাল স্পোর্টিং ক্লাবেরও (এই ক্লাবটি কিন্তু শেখ কামালের নামে নয়)। কারণটাও খুব সরল। আবাহনীর পাশাপাশি এই ক্লাবগুলোতেও তখন ছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য। তবে এই পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তিনি কখনোই কোন বড় ব্যবসায়ীর কাছে ধর্ণা দেননি। অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন আবাহনীর জন্য চারতলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাবও। যারা শুধু বিভিন্ন সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন শুধু তাদেরই অধিকার ছিল শেখ কামালের এই ক্রীড়াযজ্ঞে দশ-বিশ-একশ টাকা চাঁদা দেয়ার। তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার সুযোগে যাতে কেউ কোন ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে না পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন তিনি বরাবরই।
খেলার সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগও ঘটিয়েছিলেন তিনি অদ্ভুত দক্ষতায়। ইস্ট এ্যান্ড আর ব্রাদার্স ইউনিয়নে তার যোগাযোগের সুবাদে পুরো পুরনো ঢাকায়, বিশেষ করে ওখানকার শিল্পাঞ্চলগুলোতে তার বিশাল অনুসারী বলয় তৈরি হয়, যার সুফল এখনও আওয়ামী লীগ ভোগ করছে। ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট করতে নামার আগে রকিবুল হাসানের ক্রিকেট ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকারটাও সেঁটে দেয়া হয়েছিল শেখ কামালের পরামর্শেই।শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী। হারমোনিয়াম বাজিয়ে শুধু গান-ই গাইতেন না, বাজাতেন সেতারও। ইস্কাটনে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর অফিসে রিহার্সালের জন্য নিজের ঊনসত্তর মডেলের টয়োটায় করে সারা ঢাকা শহর ঘুরে নিয়ে আসতেন শিল্পীদের, যন্ত্রীদের।
এদেশের প্রথম নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতাও শেখ কামাল। স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন ঢাকা থিয়েটারের জন্ম শেখ কামালের হাত ধরেই। এ জন্য ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার ভাঙ্গাচোরা অডিটোরিয়ামটা তিনি ঠিক করিয়েছিলেন অনেক তদ্বির করে। নাটক মঞ্চায়নের আগের দিন রাত সাড়ে এগারোটায় চান মিয়া ডেকোরেটরকে অনুরোধ করে চেয়ারের ব্যবস্থা করেছিলেন দর্শকদের জন্য। আর প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের পাশাপাশি সয়লাব যখন অডিটোরিয়ামটিও তখন নিজে হাত লাগিয়েছেন তা পরিষ্কারে। এভাবেই মঞ্চায়িত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চ নাটকটি। নিজেও তুখোর অভিনেতা ছিলেন শেখ কামাল। বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ নাটকের নাম জানতে চান? ‘ত্রি-রত্ন’- মাত্র দুটি এপিসোড প্রচারিত হয়েছিল নাটকটির পচাত্তরের পনেরোই আগস্ট পর্যন্ত। এর নির্দেশনায় ছিলেন শেখ কামাল, স্ক্রিপ্টও তারই। আর অভিনয়ে শেখ কামাল ও অন্যরা।একজন শেখ কামালের শূন্যতা যে কি বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয়, তার উদাহরণ তো আজকে আমাদের চারপাশেই। কোভিড-১৯-এর বাস্তবতায় আজকের বাংলাদেশে একজন সব্যসাচী শেখ কামালের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ